দ্বন্দ্ব ।। তাসনিম হালিম মিম
রোজকার আড্ডা দেওয়ার জায়গাটা অনেক বেশি শান্ত দেখাচ্ছে। হল্লানেই, তর্কনেই। দেখে মুহিব নিজের অজান্তেই সামান্য চমকায় তাদের পাড়ায় ঢোকবার এবং বের হবার যে একমাত্র রাস্তা সেটির মাথাতেই ঈসমাইল চাচার চায়ের দোকান। দোকান ঘেঁষে বসিয়ে রাখা তিন চারটি কাঠের বেঞ্চ মুহিব আর তার বন্ধুদের আড্ডা মেরে সময় কাটাবার তীর্থস্থান। মুহিব, অনন্ত রহমান, আর মাঝে মাঝে সেতু। এই পাড়ায় মুহিবরা আসার পর থেকেই ওদের সাথে বন্ধুত্ব। পকেটে কড়ির ঘাটতি থাকায় এবং ঈসমাইল চাচার উপর মায়া পরে যাওয়ায়, একেবারেই বাহুল্য বিবর্জিত এই চায়ের দোকান ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে বসার কথা ওরা ভাবতেও পারেনা। কিন্তু আজ কেউ নেই কেন!
বিকাল ৫ টার মতো বাজে এখন। মুহিবের হাতে ঘড়ি নেই, তবুও পকেট থেকে ফোন বের না করেও সে বলতে পারে। ৪ টায় অফিস থেকে বের হয়েছে। তারপর বাসের জন্য অস্থিরভাবে অপেক্ষা করতে করতে ঘন ঘন ঘড়ি দেখেছে। বাস একবার এসে পড়লে এপর্যন্ত আসতে আধ ঘন্টার বেশি লাগে না। সব মিলিয়ে ৫টার মতো বাজবে এখন। মুহিব ঈসমাইল চাচার দোকানের পঁচা কাঠের বেঞ্চগুলোর একটাতে বসল। ক্লান্ত সে, চোয়ালের চারপাশটা তার বরাবরই ব্যথা করে।
“চাচা, চা দিও।“ মুহিব অনেকটা আবদারের সুরে বলে।
“দিই”। ঈসমাইল চাচার মুখ গোমড়া।
“কি ব্যাপার! মন খারাপ নাকি?” মুহিব প্যাকেট থেকে একটা বেনসন রেগুলার টেনে নিতে নিতে বলে।
“আপনার বন্ধুরা কই?”
মুহিব হেসে ফেলে। হ্যাঁ, তার বন্ধুদের দেখা না পেলে চাচার মেজাজ খারাপ হওয়ার সঙ্গত কারণ আছে। বারো-পনের কাপ চা আর গোটা বিশেক সিগারেট কম বিক্রি হওয়া চাচার ভালো নাই লাগতে পারে।
“এসে যাবে চাচা।“ মুহিব সান্ত্বনা দেয়। “অনন্ত চাকরির খোঁজে ঘুরছে বোধহয়। আর বাঁকিদের অফিস থেকে ফিরতে দেরি হচ্ছে।“
মুহিব যে বেঞ্চে বসেছিল তার থেকে খানিকটা দূরে রাখা আরেকটা বেঞ্চের অপর মাথায় একটি মেয়ে এসে বসে। বসে নিজের ফোনের দিকে মনোযোগ দেয়। মুহিব অবাক হয় না। কয়েক বছর আগেও মেয়েরা পাড়ার চায়ের দোকানে কখনো বসত না। এখন অহরহই বসছে। তাদের সেতু তো এমনকি মানুষের কপালে ওঠা চোখের সামনে সিগারেটও ধরায়।মেয়েটা গোণেই না মানুষ কি বলবে সেই বিষয়টা। যাই হোক, কোথায় ওরা! সেতু, রহমান। চায়ের খালি কাপটা পাশে রেখে প্রথমে সেতুকেই ফোন করে সে।
“কি রে!” ওপাশ থেকে সেতুর গলার স্বরের সাথে আরো একশ একটা গলা গজরে ওঠে যেন।
“কোথায় তুই? এতো শব্দ কিসের!” মুহিবকে প্রায় চিৎকার করে বলতে হয়। শব্দের চোটে সেতু শুনতেই পাচ্ছে না।
কয়েকবার চেষ্টার পর সেতু বলতে পারে, “বললাম না তোদের সেদিন? আজ আমার স্কুল ফ্রেন্ডের গায়ে হলুদ। ওদের বাসায় এসেছি। আজ আমরা স্কুলের বন্ধুরা একসাথে থাকব এখানে।“
সেতু ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে আরো কিসব বলছিল। কিন্তু মুহিবের শুনতে ইচ্ছা হল না। সে কল কেটে দিয়ে একটু গম্ভীর হয়ে বসে। বটে, সেতু বলেছিল, তবে ওর মনে নেই কেন! নিজের স্মৃতিশক্তি নিয়ে খুব একটা গর্ব মুহিবের কখনোই ছিল না। স্কুলে থাকতে বাংলা, সমাজে ও বরাবরই কম নাম্বার পেত কবিতা আর ঘটনার সাল মনে রাখতে পারত না বলে। কিন্তু সেতুর ব্যাপারটা আলাদা। তার একটা কথা শোনার পরও মুহিব ভুলে যাবে এ কেমন করে হয়। মেয়েটাকে ও খুবই পছন্দ করে। মাঝেমাঝে মনে হয়, ভালোই বাসে। জানাতে সাহস পায় না, কারণ, সেতু চোখ বুজে মানা করে দিবে। সে রীতিমতো ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত এখন। বর্তমানে সে একটা জাতীয় পত্রিকার জন্য গল্প অনুবাদের কাজ করছে। ফরাসি গল্প। প্রতি শুক্রবার পত্রিকাটির সাহিত্য পাতায় সেতুর অনুবাদ করা একটা গল্প থাকে। এরপর না কি সে একটা উপন্যাসও অনুবাদ করবে। এর জন্য সে রীতিমতো টাকা-পয়সা দিয়ে অনলাইনে নেটিভ ফরাসি ভাষার কোর্স করছে। সবমিলিয়ে মহাব্যস্ত একটা মানুষ।
“আজ ব্যাঙ ডাকানো বৃষ্টি হবে”। মুহিব সোজা হয়ে বসে। একবার ইসমাইল চাচা আরেকবার অন্যপাশের বেঞ্চে বসা মেয়েটার দিকে তাকায় সে। না, কেউ বলে নি কথাটা। দুজনই নিজ কাজে ব্যস্ত। একজন চায়ের কেটলিতে, আরেকজন এখনো ফোনে। মুহিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অনেকক্ষণ সে কারো সাথে কথা বলে নি। তাকে কথা বলতে হবে। এবার রহমানকে ফোনে ধরার চেষ্টা করে সে।
“জি স্যার, বলুন।“ রহমান কখনো ফোনে ‘হ্যালো’ বলে না।
“কোথায় তুই?” মুহিব নিজের গলার স্বরে হালকা কাঁপন টের পায়।
“আশ্চর্য, তোকে বললাম না সেদিন। বৃহস্পতিবার নিশাতের সাথে আমার ডেইট। আজ কি বার?”
“ওহ! ভুলে গিয়েছিলাম। যাই হোক, কখন আসবি।“
“দেরি হবে। আমরা এখন রিক্সায় ঘুরছি। রাতে খাব একসাথে।“
“বাহ! চমৎকার!”
“কি ব্যাপার! তুই রেগে যাচ্ছিস কেন?” এবার রহমানের গলা থমথমে হয়ে ওঠে।
“কিছু না। নিশাতকে হ্যালো বলিস।“ মুহিব ফোন রেখে দেয়।
মাথার উপরের খোলা আকাশের দিকে তাকায় সে। সন্ধ্যে নেমে আসছে। আকাশ অন্ধকার না হয়ে, কেমন যেন হলদেতে হয়ে ওঠেছে। আশপাশের সবকিছুই হঠাৎ করে জন্ডিস রোগির চোখের মতো হলুদ দেখাচ্ছে।
“পড়ন্ত সূর্যের আলো যখন আকাশে জমে থাকা মেঘে প্রতিফলিত হয়, তখন পৃথিবীর রঙ এমন হয়ে যায়।“ মুহিব ঠোঁট কামড়ায়। “বিশেষত, যে মেঘে বৃষ্টি হবে।“ কন্ঠস্বরটি হালকা গলায় যুক্ত করে।
মুহিবের এখন কার সাথে কথা বলা উচিত? ইসমাইল চাচার সাথে না কি মেয়েটার সাথে? না কি অনন্তকে ফোন দিবে। বেকার অনন্ত চাকরির সন্ধানে না কি আজ কোথায় যাবে! তার মেজাজ তিরিক্ষি থাকার কথা। দয়াদাতার সামনে চাকরির আশায় দাঁত কেলিয়ে বসে থাকাটা সুখকর কোনো পরিস্থিতি না। অনন্তটা বরাবরই বাউন্ডূলে, ভুগছেও তেমনি। ইসস! ওপাশের মেয়েটার সামনের বেঞ্চে একটি ছেলে এসে বসেছে। মেয়েটার দৃষ্টি এবার ফোনের স্ক্রিন থেকে সরে ছেলেটার দিকে আবদ্ধ হয়েছে। দুজনে বেশ হাসছে, নিচু স্বরে কথা বলছে। মুহিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়েটার সাথে আগেই কথাবার্তা এগিয়ে রাখলে, এখন তিনজনে বেশ আড্ডা দিতে পারত। উলটো ছেলেটা এখন মুহিবের দিকে কড়া চোখে তাকাচ্ছে। ভাবটা এমন, সে বুঝতে পেরেছে সে আসার আগেও মুহিব মেয়েটার দিকে কয়েকবার আড়চোখে তাকিয়েছে। ছেলেটা চেঁচিয়ে ইসমাইল চাচাকে চা দিতে বলে।
চাচার চা বানানো ও পরিবেশনের পর মুহিব তাকে ডাকে, “চাচা, কাজ নাই তো তোমার। বসো, একটু গল্প করি।“
ইসমাইল একটা বিড়ি ধরিয়ে মুহিবের সামনে এসে বসে। “কাস্টমার কমই আজকে। আপনের বন্ধুরাই নাই।“
“ওরা আজ কেউ আসবে না বোধহয়। সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত।“ মুহিব আর ইসমাইল চাচা যেন প্রতিযোগিতা করে অভিমান করছে সেতু, রহমান, অনন্তদের উপর।
“থাক গা। আইজ দোকান এমনিতেও তুইল্লা দিতাম তাড়াতাড়ি। বৃষ্টি আইবো।“
মুহিব ঠান্ডা চোখে তাকায় ইসমাইল চাচার দিকে। চাচা বিড়িতে লম্বা টান দিয়ে হেসে বলে, “আপনের কষ্টই হইল আজ। কথা বলার মানুষ নাই।“
“বুড়োও বুঝে গেছে বোকাটার সবসময় কথা বলার মানুষ দরকার“ স্পষ্ট কণ্ঠস্বরে মুহিব চঞ্চল হয়ে ওঠে। ইসমাইল চাচা কথা বলছে, এর মধ্যেও ও কীভাবে কণ্ঠস্বরটা শুনতে পেল!
“বাসায় চইল্যা যান, মুহিব ভাই। বৃষ্টি আইলে ১০ মিনিটে পানি জইম্যা যাইব।“
মুহিব মাথা নাড়ে, ওঠা দরকার আসলেই। আকাশে মেঘ গুড়গুড় করতে শুরু করেছে। মুষলধারে বৃষ্টি হলে তাদের পাড়াটা সত্যিই সত্যিই দশ মিনিট না হলেও আধঘন্টার মধ্যে কোমড়-পানিতে ডুবে যায়। ফুটপাতে চাচার চায়ের দোকানে বৃষ্টির মাঝে আটকা পরে, তারপর পঁচা পানি ঠেলতে ঠেলতে বাসায় যাওয়ার মানেই হয় না। বাসায় মা আছে, তার সাথেই বরং গল্প করা যাবে।
চা-সিগারেটের বিল মিটিয়ে দিতে দিতে মুহিব ওপাশটা বার আরেকবার লক্ষ্য করে। মেয়েটা আবার একা, ছেলেটা নেই সামনে। মেয়েটার দৃষ্টি আর ফোনের স্ক্রিনের দিকেও নেই। সামনের একঘেয়ে রাস্তাটার একঘেয়ে জীবন দেখতে দেখতে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। মুহিব খেয়াল করে মেয়েটা বেশ সুন্দর। এতো মসৃণ ত্বক খুব বেশি মানুষের দেখেনি সে, মুখের ভেতর বড় বড় চোখের অবস্থান আলাদা করে নজর কাড়ে। মেয়েটার পরনে ধবধবে সাদা একটা সালোয়ার কামিজ। কিছুদিন আগেও মানুষ সহজে সাদা কিছু পড়তে চাইত না, ময়লা হওয়ার ভয়ে। আজকাল রীতিমতো ফ্যাশন করে পরছে। এতো নিখুঁত একটি প্রেমিকাকে এই মেঘ ডাকানো দুর্দান্ত রোমান্টিক আবহাওয়ায় ফেলে রেখে কোনো প্রেমিক ওঠে যেতে পারে! আশ্চর্য!
“ছেলেটা ওর প্রেমিক নয়। আর মেয়েটাকে তুমি চেন। গিয়ে কথা বলতে পারো।“ কণ্ঠস্বরটি তরল গলায় বলে ওঠে। মুহিবের মেরুদন্ডে শীতল কিছু একটা স্পর্শ করল যেন। সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে সে মেয়েটার সামনে গেল। মেয়েটা চোখ তুলে তাকিয়ে ভুরু সামান্য কোঁচকায়।
“জি ?”
“স্যরি, আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছিল। কিন্তু মনে করতে পারছিলাম না।“ মুহিব খুবই দ্বিধান্বিতভাবে বলে।
“আমি তো আপনাকে চিনি না।” মেয়েটা অস্বস্তির সাথে বলে। বোঝাই যাচ্ছে, মুহিবের উপস্থিতি সে একেবারেই পছন্দ করছে না।
মুহিব এবার বিপদে পরে যায়। মরিয়া হয়ে বলে, “আপনি কি এ পাড়াতেই থাকেন?”
মেয়েটা এবার রুক্ষভাবে বলে, “তাতে আপনার কি দরকার? আপনি অনেকক্ষণ ধরেই আমাকে ফলো করছেন, আমি খেয়াল করেছি।“
মুহিব এবার একেবারেই মিইয়ে গেল। কথাটা খুবই সত্য। সে আমতা আমতা করে বলল, “স্যরি! মনে হচ্ছিল আপনাকে চিনি, এজন্য…”
মেয়েটা আর কিছু না বলে ফোনের দিকে মনোযোগ দিল। ইঙ্গিতটা খুব সোজা। বিরক্ত না করে বিদায় হও।
অপমানে মুখ লাল করে চলে যাওয়ার সময় মুহিব পুরো ব্যাপারটা একটু ভাবার চেষ্টা করে। নিজের মনে খুব বেশি ভাবার অভ্যাস তার নেই। হ্যাঁ, সে মেয়েটির দিকে কয়েকবার তাকিয়েছে, কিন্তু বাজে ভাবে তো না। তাছাড়া সে ভেবেছিল, মেয়েটা খেয়াল করেনি তার কর্মকান্ড। সেটা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ হয়ে গেল। কিন্তু সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ ব্যাপার যেটা, মেয়েটাকে মুহিব চেনে, একথা কেন সে বলল? ভাবতে পারলো না বেশিক্ষণ। বাসায় পৌছানোর খানিকটা আগেই পুরো আকাশ যেন ভেঙে পানি হয়ে নেমে এলো তার মাথায়। হুট করে এমন ঝুম বৃষ্টি এলো যে দৌড়ে বাসা পর্যন্ত পৌছানোর মিনিট খানেক সময়েই সে ভিজে কাক হয়ে ওঠল।
২
চাবি দিয়ে বাসার দরজা খুলে ভেজা শরীরে সে আগে নিজের ঘরে গেল কাপড় পাল্টাতে। তার ঘর ঢুকলে যে কারো মন খারাপ হয়ে যাবে। দেয়ালে সবুজ পেইন্ট করা, সবুজ রঙটাকে জীবনের চিহ্নই ধরা হয়। কিন্তু দেয়ালের এই সবুজ রঙের মধ্যে কেমন যেন একটা অসুস্থ ভাব রয়েছে।পঁচাখাবারের উপর যে রঙয়ের ছত্রাক ধরে, সে রঙটাই মুহিবের ঘরের দেয়ালে লেপে দেওয়া আছে। তার বিছানার চাদর অগোছালো, মেঝের এক কোণায় অধোয়া কাপড় স্তুপ করে রাখা। সাধারণত বাসায় মা থাকলে ব্যাচেলরদের ঘরও গোছানো থাকে। কিন্তু মুহিবের মা ঘর গোছানোর মতো ছোটখাটো কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না। এই মুহূর্তে তিনি বাসায় নেই। তার ঘরের আলো নেভানো আর মুহিব বাসায় ঢুকলে তিনি দরজায় এগিয়ে আসেন, আজ সেরকমটা হয় নি।
কাপড় পালটে ভেজা কাপড়গুলো বারান্দায় মেলে দিল মুহিব। তাদের বাসায় একটাই বারান্দা। মার ঘরের সাথে লাগানো। মাকে একাই থাকতে হয় বাসায়। তাই সময় কাটানোর জন্য আশেপাশের বিভিন্ন বাসার বাসিন্দাদের সাথে আত্মীয়তা পাতিয়ে বসেছে। সেরকমই হয়তো কোথাও গিয়েছে। খুব সাধারণ এই বিষয়টাতে মুহিবের মন অত্যন্ত দমে গেল। অনেকক্ষণ তার কারো সাথে কথা হয় নি। আসলেই অনেকক্ষণ কী? এই কিছুক্ষণ আগেই না সে ওই মেয়েটার সাথে কথা বলল, যদিও তিক্ত কথোপকথন। তবু মনে হচ্ছে, কতকাল আগের ঘটনা!
“এবার? আমি আর তুমি। একা শেষ পর্যন্ত।“ বাসায় কেউ নেই জেনেও মুহিব অপর কণ্ঠস্বরটি শুনে চমকায় না। শুধু পকেটে হাত দিয়ে হঠাৎ সে ভীষণ চঞ্চল হয়ে ওঠে। বাসায় এসে ভেজা কাপড় পালটে শুকনো যে ট্রাউজারটি সে পরেছে সেটির পকেটে তার ফোন নেই। ছুটি গিয়ে তার অফিসের ব্যাগটা নিয়ে এপকেট-ওপকেট হাতাতে থাকে সে। ব্যাগটার বাইরের পকেটেই সে ফোন রাখে। কিন্তু কোনো পকেটেই জিনিসটা খুঁজে পেল না। ঘরের টেবিল, বিছানার আঁতি-পাতি ভালো করে খুঁজে দেখে। না। নেই।
“বন্ধ করো তো এসব। তুমি নিজেও জানো, ওটা তুমি আর পাচ্ছ না। বুড়োর চায়ের দোকানের বেঞ্চে ফেলে রেখে এসেছ।“ সে খিক খিক করে হাসতে হাসতে বলে।
“চুপ!!” মুহিব প্রথমবারের মতো চেঁচিয়ে ওঠে কন্ঠস্বরটার প্রতি। হিংস্র চিৎকার।
বাইরে বাজ পরার সাথে সাথে বিদ্যুৎ চলে গিয়ে সারাবাসা অন্ধকার হয়ে গেল।
“বেচারা! তোমার কম্পিউটারটাও এখন আর কাজে আসবে না।“ কণ্ঠস্বরটি সত্যিকারের সহানুভূতি মেশানো গলায় মুহিবকে তথ্যটি জানিয়ে দিল।
৩
অন্ধকারে একা বসে মুহিব ভাবতে থাকে। তার ঘরের ভেতর এতো অন্ধকার যে মাটির নিচে থাকা কফিনের ভেতরকার কথা মাথায় আসে। তাতে মুহিবের অসুবিধা হয় না অবশ্য, অন্ধকারকে ওর ভয় নেই। ভয় সে পায় নিজের ভাবনাকে। এই মুহূর্তে সে নিজের সাথে একা- এই চিন্তাটা তাকে এতো ভয় দেখায় যে তার আর্তনাদ করতে ইচ্ছা করে। কন্ঠস্বরটি এই মুহূর্তে চুপচাপ। কিন্তু মুহিব জানে, শিকারকে একদম থাবার নিজে রেখে পশু যেমন অলস নিস্পৃহতায় কিছুক্ষণ বসে থাকে, উপভোগ করে শিকারের ছটফটানি, তার সাথেও ঠিক সেটাই হচ্ছে।
নিজের গালে হাত বোলায় মুহিব, চোয়ালের আশপাশটায়। ওই জায়গাটায় তার সবসময়ই টান ধরা এক ধরনের ব্যথা থাকে। মানুষের অনেক রকম শখ থাকে। কেউ বই পড়ে, কেউ ছবি আঁকে, অনেকে সিনেমা-নাটক দেখে সময় কাটায়, সেতু তো এমনকি লেখালেখিও করে। মুহিবের কোনো শখ কখনো তৈরি হতে পারে নি, কারণ কথা বলা ছাড়া সে অন্য কোনো কাজে খুব বেশিক্ষণ সময়ব্যয় করতে পারে না। শুধুমাত্র নিজের উপস্থিতিতে থাকা অর্থাৎ নিজের সাথে সময় কাটানো, এটা তার জন্য খুবই ভয়ংকর ব্যাপার। স্বস্তির বিষয় এই যে, এই যুগে মানুষ বস্তুতভাবে যদিও কখনো-সখনো একা থাকে, প্রকৃত অর্থে কখনোই একা থাকতে হয় না। হাতের মুঠোয় থাকে ফোন, তাতে ফেসবুক, তাতে অজস্র মানুষের উপস্থিতি। সুতরাং সামনে কেউ না থাকলেও কথা বলার উপায়ের অভাব নেই। এছাড়া সময় কাটানোর জন্য রয়েছে একশ একটা গেম, ইউটিউব। মুহিব সবই ট্রাই করেছে। কিন্তু একদম চোখের সামনে অন্য একজন মানুষের উপস্থিতি এবং তার সাথে কথোপথন চালিয়ে যাওয়ার মতো বেশি কাজে আর কিছুই আসে নি।
তাই মুহিব এমন চাকরি নিয়েছে একটা কলসেন্টারে, যেখানে তার কাজই মানুষকে ফোন দিয়ে কথা বলা। বাস ছাড়া সে চলাচল করে না, যাতে সহযাত্রীটির সাথে সে আলাপ জুড়ে দিতে পারে। পাশের যাত্রীটি যতই শীতল আচরণ করুক না কেন, মুহিব নিজের মনে একটানা কথা বলে যায়। অফিস থেকে এসেই চায়ের দোকানে আড্ডায় বসে পরে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু তার গুটিখানেক হলেও, চা খেতে আসা পাড়ার অর্ধ-পরিচিত মানুষদের সাথেও সে খুব আগ্রহ নিয়ে গল্প করে। চেনা-জানা মানুষের গন্ডী যত বাড়ে, মুহিবের জন্য তত ভালো।
এই মুহূর্তে অন্ধকারে বসে বসে মুহিব নিজের নির্বুদ্ধিতার কথা ভাবছিল। সে কি ভেবেছিল? অফিস, চায়ের দোকান, আর বাস ছাড়া সে কোথাও একা হবে না? নিজের বাসাটার কথাই এভাবে ভুলে গেল। আসলে বাসার কথাটা সে অত গুরত্ব দিয়ে ভাবেনি কারণ, সবসময় মা থাকে, তার উপর অল্প কিছু সময় কাটানোর জন্য সে ফোনটাও ব্যবহার করতে পারে, কম্পিউটারে গেম খেলতে পারে। এজন্যই তার বিল্ডিং এর অন্যান্য বাসার মানুষজনের সাথে পরিচিত হবার কথা তার মাথায় আসে নি। খুব বেশি সময়ও পায় নি, তারা এ পাড়ায় ওঠেছেই বছর খানেক হলো মাত্র।
কোথাও খুট করে শব্দ হওয়ায় তার চিন্তাসূত্র কেটে যায়। ভালো করে শোনার চেষ্টা করে বুঝল শব্দটা রান্নাঘর থেকে আসছে। অত একটা পাত্তা দেওয়া উচিত না, বাসায় ইঁদুর তো থাকেই। কিন্তু মুহিব ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। এতোক্ষণ নিশ্চল হয়ে বসে ছিল সে, এবার পা টিপে টিপে ওঠে প্রথমে তার ঘরের জানালাগুলো খুলে দেয়।সাধারণত সেগুলো খোলাই থাকে, আজ কেন যেন আটকানো ছিল। বৃষ্টির ছিঁটের সাথে এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস বদ্ধ ঘরে ঢুকল। সাথে ঢুকল এক চিলতে ধোঁয়াটে আলো। বৃষ্টির রাত, বাইরে আলো থাকার কথা নয়। কিন্তু আকাশ বোধহয় কখনো আলোহীন হয় না। যত অল্পই হোক আলোর কিছু আভা সে সবসময়ই মজুত রাখে। বাইরে এখনো ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘের আওয়াজের সাথে মাঝে মাঝে ঝলক দেওয়া আলোর উপর ভরসা করে মুহিব তার টেবিলের ড্রয়ার খুলে মোমবাতি খুঁজতে থাকে। নেই। তাকে রান্নাঘরে যেতেই হবে। সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে রান্নাঘরে রাখা শেলফের বিভিন্ন তাক কেউ একজন হাতড়াচ্ছে।
রান্নাঘরটা মুহিবের রুমের মতো এতোটা অন্ধকার নয়। খোলামেলা জানালায় পর্দা না থাকায় বেশ খানিকটা বিবর্ণ আলো রান্নাঘরটা দেখার উপযোগি করে রেখেছে। মুহিব তাই রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে যখন একজন মানুষকে আতিপাতি করে কাবার্ডের উপরের তাকটা হাতড়াতে দেখল, তখন সে একেবারেই অবাক হলো না। মানুষটা সে খুব ভালো করে চেনে। শুধু আশ্চর্য একটা ভয় তাকে পাথরের পুতুল বানিয়ে চৌকাঠে দাঁড় করিয়ে রাখল। অন্ধকার আর আবছা আলোর খেলাতে চোখ এতোক্ষণে সয়ে এসেছে। তাই সেই মানুষটার সুন্দর হাসি দেখতে তার তেমন অসুবিধা হলো। “মোমবাতি জ্বালানো দরকার। তাই না? অন্ধকারে আর কতক্ষণ?” মুহিবের দিকে তাকিয়ে লোকটা হালকা ফুর্তির গলায় বলল।
৪
মোমবাতি জ্বালানোর পর স্বাভাবিক অন্ধকার রাতটা কেমন যেন আধভৌতিক লাগতে থাকে মুহিবের কাছে। সামান্য হলদে আলোয় লোকটাকে মনোযোগ দিয়ে দেখে । তার এখন একেবারেই ভয় লাগছে না। তার কারণ বোধহয়, যা হওয়ার সম্ভবনায় সে ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিল, তা এখন একদম তার চোখের সামনে জলজ্যান্তভাবে ঘুরছে। লোকটা মুহিবের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে মোমবাতির আলোয় ধরাচ্ছে এই মুহূর্তে। তার নাম মুহিব জানে না। শুধু চেহারা চেনা আর কণ্ঠস্বরটা খুবই চেনা। ভারী অথচ হালকা ফুর্তি মেশানো একটা কণ্ঠস্বর। লোকটা আর মুহিব এখন ছোট্ট ডাইনিং টেবিলটার দুপাশে দুটো চেয়ার নিয়ে বসে আছে। টেবিলের উপর সিগারেটের প্যাকেট, মোমবাতি। হালকা বাতাসে দপ দপ করে উঠছে মাঝে মাঝেই।
“তারপর মুহিব! অনেকদিন পর দেখা।“ লোকটা চোখ তুলে তাকায় মুহিবের দিকে।
মুহিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
সিগারেটে লম্বা টান লোকটা হাসে, “ভুল বললাম একটু। তোমার অনেকদিন পর দেখা আমার সাথে। আমি তো তোমাকে প্রায় সবসময়েই দেখি।“
“বিদ্যুৎ অনেকক্ষণ ধরে নেই। চলে আসবে তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই। তখন তোমাকে চলে যেতে হবে।“ মুহিব কষ্ট করে গলায় আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার চেষ্টা করে।
“সে কি! কেন? আমি তো ভূত নই যে আলো দেখে পালাব। বরং আমিই তো তোমাকে মোমবাতি ধরাতে বললাম, তাই না?” লোকটা মিষ্টি হাসল।
দেখে মুহিবের গা শিরশির করতে থাকে।
“এসব অভ্যাস বাদ দাও মুহিব। কোনো লাভ হয় না এতে। কি ভেবেছ! বিদ্যুৎ আসলে কম্পিউটারের সামনে বসবে, আর আমাকে ভুলে যাবে!” লোকটার মুখ থেকে হাসি মুছে গেছে, মুহিবের দিকে এখন স্থির চোখে তাকিয়ে আছে।
“এতো বছর এভাবেই কাজ করেছে। বন্ধুবান্ধব, ফোন, কম্পিউটার সবকিছু তোমাকে আমার জীবন থেকে দূরে রেখেছে।“
“তবু দেখো, আজ আমরা আবার একসাথে, তাই না? মনে হচ্ছে উপরওয়ালা নিজেই চাইছে আমরা একসাথে থাকি।“
“না…।“
“হ্যাঁ। ভেবে দেখো, কি সুন্দর সাজানো পুরো ব্যাপারটা। আজকে তোমার বন্ধুরা কেউ নেই, আজকেই তোমার ফোন হারালো, আজকেই বৃষ্টির কারণে বিদ্যুৎ নেই। হা হা হা…। পুরো প্রকৃতি চাইছে, আমরা দুজন মুখোমুখি বসি।“
মুহিব হতাশায় হাতের তালুতে নিজের মুখ চেপে ধরে।
“ভেবে দেখো। আমাকে আসলে তোমার দরকার।“ লোকটা এবার খুব সিরিয়াস গলায় বলে।
“মা চলে আসবে। মা চলে আসবে। অবশ্যই আসবে। “ মুহিব বিড়বিড় করে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে থাকে।
“তাই না কি?” লোকটার মুখে এখনো হাসি। মোমবাতিটা নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল সে। কিছু একটা করছে সেখানে। খুঁটখাঁট আওয়াজ হচ্ছে। মুহিব ডাইনিং টেবিলে অন্ধকারের মধ্যেই স্থির হয়ে বসে থাকে। তার এই মুহূর্তে এই বাসা থেকে পালানো উচিত। ডাইনিং রুমটা পার হলেই বাসার সদর দরজা। বিল্ডিং এর যে কোনো একটা বাসায় গিয়ে কারো কাছ থেকে ফোন নিয়ে মাকে ফোন দেওয়া উচিত। তারপর উচিত সেখানেই বসে অপেক্ষা করা। সেটা করার বদলে মুহিব পায়ে পায়ে রান্নাঘরে এসে পৌছালো। রান্না বসিয়েছে লোকটা। এক চুলায় ইতিমধ্যে ভাতের পাতিল ওঠে গেছে। আরেকচুলায় ডিম ভাজা হবে মনে হয়। চাকু দিয়ে পেঁয়াজ-মরিচ কাটাকাটি চলছে।
লোকটা ঘুরে তাকিয়ে হাসল, “কি আর বলব! একটু সাহায্য পেলে মন্দ হতো না।“
দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই মুহিব মাথা নাড়ে। সাহায্য করতে সে প্রস্তুত নয়। বাইরে মেঘের গর্জনের সাথে আলো ঝলক দিয়ে গেল। তাতেই লোকটার হাতের সবজিকাটা ছুরি ঝলকে ওঠল যেন। মোমবাতি দপ করে নিভে গেল।
এই সুযোগ! পা টিপে টিপে আন্দাজে সদর দরজায় পৌছাতে তার কোনো অসুবিধা হয় না। বাসাটাকে সে খুব ভালো করে চেনে। হাতড়ে হাড়তে ছিটকিনি খুঁজে দরজা খুলে দৌড়ে বের হয়ে যাওয়ার অল্পক্ষণ সময়টায় তার হৃদপিন্ড ঢাকের মতো বাজতে থাকে। সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে গেল সে। তাদের বাসাটার ঠিক নিচে প্রথম বাসাটায় কিছুক্ষণ দরজা ধাক্কালো। এরপরই মুহূর্তের বিজলির আলোয় দরজায় লাগানো বিশাল তালাটা তাকে ভ্যাঙচালো। সে এবার আরো এক ফ্লোর নিচে দৌড়াল।
দরজা ধাক্কাতেই চার্জার হাতে নিয়ে যে মেয়েটা দরজা খুলল, তাকে দেখে মুহিব থতমত খেয়ে গেল। চায়ের দোকানের মেয়েটা।
মেয়েটার চোখে ভয়। সেও মুহিবকে চিনতে পেরেছে। প্রায় চেঁচিয়ে বলল, “আপনি? কি চান?”
মুহিব এবার মরিয়া হয়ে বলে, “আমি উপরের তলায় থাকি। আমি একটা ফোন করব শুধু।“
“না না। বাসায় কেউ নেই। আপনি পরে আসুন।“ মেয়েটা আতঙ্কের সাথেই দরজা বন্ধ করে দিতে গেল।
মুহিব সর্বশক্তি দিয়ে সেটা আটকালো। “প্লিজ! আমি এখানেই দাঁড়াচ্ছি। আপনি শুধু ভেতর থেকে ফোন নিয়ে আসুন। আমার খুব দরকার।“
মেয়েটা এবার ফোঁপাতে শুরু করে। “আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। আপনি বদ মতলবে এখানে এসেছেন। এখন বাসায় ঢুকতে চাচ্ছেন…।“ মুহিব মেয়েটার কথা শুনে এই বিপদের মধ্যেও মুহিব পিছু হটে গেল।
মেয়েটা গলা ফাটিয়ে চেঁচাল এবার, “এক্ষুণি চলে যান এখান থেকে।“
হতবুদ্ধি মুহিব বিনা বাক্যব্যয়ে সরে দাঁড়াল। তার মুখের সামনে দরাম করে দরজা আটকে গেল।
কি হয়ে গেল ব্যাপারটা। মেয়েটার বাসার দরজার সামনেই সে কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। অনেকক্ষণ, দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে। হ্যাঁ, বাসায় একা থাকা কমবয়সী একটা মেয়ে আরেকটা যুবককে বাসায় ঢুকতে দিতে নাই চাইতে পারে। এতে এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। আর মেয়েটা মুহিবকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতর থেকে ফোন এনে দেওয়ার ভদ্রতা পর্যন্ত করেনি, তার কারণ হচ্ছে আজকের চায়ের দোকানের ঘটনা। মেয়েটা তাকে সত্যিই বাজে মতলবে আসা একজন লোক ভেবেছে। হয়তো ভেবেছে, মুহিব চায়ের দোকান থেকে তাকে ফলো করছে। একটা মেয়ের এতে ভয় পেয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। এতো কিছু ভেবে বের করেও মুহিবের মন অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেল। মুখে একটা তীক্ততার স্বাদ। সে আর নিচের ফ্লোরগুলোতে গেল না। ধীরে ধীরে নিজ বাসায় ফিরে এলো।
৫
“ইন্টারেস্টিং। তাই না?” সে জিজ্ঞাসা করে।
“কোন ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং?” মুহিব মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করে।
“এই যে তুমি কত শান্তভাবে এখন পুরো বিষয়টা মেনে নিয়েছ। আসলেও ব্যাপারগুলো এতোটাও ভয়ানক না। তুমি শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছিলে।“
মুহিব চুপচাপ ভাবতে থাকে। সে মুহিবের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। আর তাতেই মুহিবের নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। পুতুলনাচের পুতুলের মতো লাগে নিজেকে।
“আচ্ছা। চায়ের দোকানে তুমি কেন বলেছিলে মেয়েটাকে আমি চিনি। আমি তো আসলেই ওকে চিনতাম না।“
“তুমি আসলেই ওকে চিনতে। ওর নাম নাসরিন। গত পরশু সে তার মায়ের সাথে এই বাসায় মিস্টি নিয়ে এসেছিল। ছোট ভাই পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছে, এইজন্য। তুমি নাসরিনকে তোমার ঘরের দরজার আড়াল থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিলে। সে তোমাকে দেখেনি, তোমার মায়ের সাথে ডাইনিং রুমে বসে গল্প করে চলে গেছে।“ লোকটা খিকখিক করে হাসল।
অপমানে মুহিবের মুখ লাল হয়ে উঠল। নোংরা হাসিটা হজম করে আস্তে আস্তে বলল, “আমার তাহলে মনে নেই কেন?”
“কারণ তুমি একটি বুদ্ধরাম। দিন-রাত কথা বলে বলে তোমার ঘিলু আর স্মৃতিশক্তি ভোঁতা হয়ে গেছে।“ তাচ্ছিল্যের সাথে বলল লোকটা। “এখন বুঝতে পারছ তো আমাকে তোমার কত দরকার?“
মুহিব এবার বসা অবস্থা থেকে লাফিয়ে ওঠে। চিৎকার করে বলে, “না! দরকার নেই। কোনো দরকার নেই আমার। দূর হয়ে যাও চোখের সামনে থেকে।“
“শুসসসস…” ঠোঁটে আঙুল চেপে মুহিবকে সে চুপ করার ইঙ্গিত দেয়। ঠোঁটের কোণায় চালাক একটা হাসি। “বেশি চেঁচামেচি করলে বিপদ আছে কিন্তু। এমনিতেই নাসরিন মেয়েটাকে রাগিয়ে দিয়ে এসেছ। এরপর তোমার গলা ফাটানো আওয়াজ শুনতে পেলে বিল্ডিং এর মানুষজন পুলিশ নিয়ে হাজির হবে।“ ফিসফিস করে বলে লোকটা।মুহিবের তেজ সাথে সাথে মিইয়ে গেল। হতাশভাবে সে চেয়ারে বসে পরল আবার। বাইরে বৃষ্টির শব্দ অনেকটা কমে গেছে। ছাদ থেকে জমে থাকা পানি নিচে পরার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে শুধু। এবার মা বা বিদ্যুৎ, যে কোনো একজন চলে আসলেই হবে, মুহিব ভাবে।
হাসির শব্দে মুহিব চোখ তুলে তাকালো। লোকটা প্রায় সহৃদয়ভাবেই হাসছে মুহিবের দিকে তাকিয়ে। “ভুলে যাওয়ার অভ্যাসটা অনেক বেড়ে গেছে না তোমার? সেতুর বান্ধবীর গায়ে হলুদ আজকে, সেটা ভুলে গেলে। রহমানের ডেইট আজকে, সেটাও ভুলে গেলে। নাসরিনকে যে তুমি বিশেষভাবে চেন সেটাও ভুলে গেলে। তুমি যে কলসেন্টারে সামান্য চাকরি গত পাঁচ বছর ধরে করছ তাতে বিশেষ অবাক হচ্ছি না।“ লোকটার সহৃদয় হাসিটা এখন তাচ্ছিল্যের হাসির মতো লাগছে মুহিবের কাছে। সেই সাথে নিজের উপর একটু ঘেন্না।
“খেতেও তো ভুলে যাচ্ছ।“ মুহিবের প্লেটের দিকে ইঙ্গিত করে লোকটা। সেখানে ভাত আর ডিমভাজা বহাল তবিয়তে পরে আছে।
“খাব না। খিদে নেই। পেট ভরাই লাগছে।“
লোকটা কাঁধ নাচাল। তার খাওয়া শেষ প্রায় আধঘন্টা হলো। তার সামনের এঁটো প্লেট আর নিজের ভরা প্লেটটা তুলে নিয়ে মুহিব রান্নাঘরে চলে গেল। সব্জি কাটার কাঠের বোর্ডের উপর বসানো মোমবাতির আলোয় রান্নাঘরের চেহারা দেখে তার ভোঁতা একধরনের রাগ হলো। এক রাশ এঁটো বাসন সিঙ্কে জমা, মেঝেতে পেঁয়াজেরখোসা, বাসন-পাতি ছড়ানো, ময়লা ফেলার বালতি থেকে পঁচা গন্ধ আসছে। মা বুড়ো হয়ে গেছে। মুহিবের ঘরের দিকে মনোযোগ দেয় না, ঠিক আছে। কিন্তু এখন কি রান্নাঘরও তার জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছে? নিদারুন বিরক্তি নিয়ে সে এঁটো প্লেটগুলো ধুতে শুরু করে।
“জিমির কথা মনে আছে?” চমকে ওঠে মুহিব তার হাত থেকে একটা পিরিচ প্রায় ফেলেই দেয়। লোকটার স্পর্ধা দেখে সে ভারী অবাক হয়ে গেল। সাথে ফিরে এলো মেরুদন্ডে শিরশির করা সেই ভয়টা।
৬
হ্যাঁ, জিমির কথা তার মনে আছে। তার ছোট ভাই জামান, সংক্ষেপে জিপি। ভারী সুন্দর ছিল দেখতে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, মাথা ভর্তি কালো চুল তার এতোই সুন্দর ছিল যে, মা ঘন ঘন কাটার তাগাদা কখনোই দিত না জিমিকে, যেমনটা দিত মুহিবকে। জিমির জন্মের তিন বছরের মাথায় তাদের বাবা মারা যায়। তারপর শহর থেকে মা গ্রামে তার শ্বশুড়বাড়িতে চলে আসে, দুই ছেলেকে নিয়ে। মুহিবের বয়স তখন মাত্র সাত। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই সে শহর দেখেছে। এবার গ্রামের নতুন খোলা পরিবেশ পেয়ে তার খুশি দেখে কে। সারাদিন দৌড়-ঝাঁপ করে খেলা তো আছেই। তার সাথে যুক্ত হলো নতুন সঙ্গীসাথীদের কাছ থেকে নতুন নতুন জিনিস শেখা। যেমনঃ গাছে ওঠা, পুকুরে সাঁতরানো, আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা। শেষোক্ত ব্যাপারটা মুহিবের মা একেবারেই পছন্দ করে নি। কিন্তু কি আর করা। এই বয়সের ছেলেকে তো আর ঘরে বেঁধে রাখা যায় না। তাই দু-একবার চড়-কিল দিয়ে ব্যাপারটা মেনেই নিলেন তিনি।
জিমির সুন্দর চেহারা তাদের দাদুবাড়িতে অন্যরকম এক প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছিল। মা ও মুহিব একরকম আশ্রিত ওই বাড়িতে। কিন্তু জিমি একেবারেই আপন সবার। মায়ের সাথে প্রায়ই চেঁচিয়ে ঝগড়া করা বড় চাচী পর্যন্ত এমনকি জিমিকে ভালোবাসত। আর জামানকে ছোট্ট করে জিমি ডাকাটা শুধু করেছিল তাদের দাদু। মুহিবের বয়স ওই সময় নিতান্তই কম হলেও ছোট ভাইয়ের প্রতি তার এক ধরনের ঈর্ষা মাঝে মাঝেই তার কাজ করত। এভাবেই দুই বছর কেটে গিয়েছিল।
মা ততোদিনে বাবার শোক চাপা দিয়ে নতুন জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে। মুহিব গ্রামের স্কুলে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। স্কুলটা মন্দ ছিল না, অন্তত নিচের ক্লাসগুলোর জন্য। ওইসময় মুহিব বেশ ধারালো ছিল। লেখাপড়ায়, কাজকর্মে। আর তার চেয়েও বেশি ছিল জিমি। সে একেবারেই আর দশটা ছেলের মতো ছিল না। বয়স তখন তার মাত্র পাঁচ। ওই বয়সে সে গুণের অংক শিখে ফেলেছিল। সাতের ঘরের নামতা বলতে পারত। অগাধ কৌতুহল তার দুনিয়ার সব বিষয় নিয়ে। সে পৃথিবীর সব বাচ্চারই থাকে। কিন্তু বেশিরভাগ অভিভাবক বাচ্চার তিনটে আবোল-তাবোল কৌতুহলী প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চার নাম্বারটিতে তাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। জিমির সাথে সাধারণত কেউ অমন করত না। বিশেষত, মা আর দাদু। তারা ঘন্টার পর ঘন্টা নিজের কাজ করতে করতে জিমির প্রশ্নের উত্তর দিত। জিমি দাদুর কাছে পড়ত, তাই বেশিরভাগ প্রশ্ন ছিল তার কাছেই। দাদু মাকে বলেছিলেন, জিমি প্রাইমারী স্কুলটা গ্রামে থেকে পড়লেও, সেকেন্ডারি্তে তাকে যেন শহরের ভালো স্কুলে পড়তে পাঠায়। এই ছেলে অনেক বড় কিছু করবে। শুনে মায়ের চোখ ভিজে ওঠত।
সব বাচ্চাকে নিয়েই তার মায়ের ধারণা থাকে, তার বাচ্চা অন্যরকম, সে বড় কিছু করবে। তাই মা মুহিবকে নিয়েও আশাবাদী ছিল। ছেলেটা চুপচাপ, নিজের মনে থাকে। গ্রামে নতুন নতুন এসে খুব খেলত। আস্তে আস্তে সেটাও কমে গেছে। স্কুলে যায় রোজ, পড়াশোনায় বেশ ভালো করছে। বাড়ি ফিরে বেশিরভাগ সময় বই সামনে নিয়েই সময় কাটায়। মানুষজনের সাথে অতো মেলামেশা নেই। গ্রামের বেশিরভাগ ছেলে-পিলে যেখানে স্কুলের পরের সময়টা টোঁ টোঁ করে কাটিয়ে দেয়, সেখানে মুহিব বড়িতেই থাকে। হয় পড়ে, নয়তো পুকুর পাড়ে গিয়ে চুপচাপ একা একা বসে থাকে, নয়তো জিমির সাথে বাগানে গিয়ে খেলে। মুহিবের স্কুলের মাস্টাররা তার দাদুকে জানিয়েছে, মুহিব ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্র। দুই ছেলেকে নিয়ে তাই মুহিবের মার গর্বের শেষ নেই।
মুহিব নিজে কিন্তু জানত, তার অতো বুদ্ধি নেই। তার একজন বন্ধু আছে। তার অনেক বুদ্ধি, অনেক চালাক সে, কিন্তু খুব লাজুক। আশেপাশে মানুষজন থাকলে সে দূর থেকে মুহিবের সাথে কথাবার্তা চালায়। মুহিব তখন তাকে দেখতে পায় না, শুধু কথাবার্তা শোনে। আস্তে আস্তে তার লজ্জা খানিকটা কেটে গেল। সে তখন জিমির সামনেও আসা শুরু করল। মুহিব আর জিমি একা থাকলে সেও আসত। খেলত ওদের সাথে। জিমি অবশ্য তার সাথে কথাবার্তা বলত না। সে নিজেও বাইরের লোকের সামনে বড় মুখচোরা কিনা এইজন্য। মুহিব তার বয়সী সেই বাচ্চা ছেলেটার প্রতি এতোই আসক্ত ছিল যে, তার অন্য কোনো সঙ্গী-সাথী দরকারই হতো না। ছেলেটার নাম সে জানে না, কখনোই তার জিজ্ঞেস করতে মনে থাকে না, আসলে নামের দরকারও নেই। তার চেহারা খুব ভালো করে চেনে মুহিব। তার সমান লম্বা, শ্যামলা গায়ের রঙ, গায়ের জোর তার চেয়ে বেশি, আর বুদ্ধি তার চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু মুহিবের তাতে হিংসা হয় না। কারণ সে মুহিবের খুব ভালো বন্ধু, অন্তরাত্মা। ক্লাসে স্যাররা যখন প্রশ্ন করে, সে মুহিবকে উত্তরটা চুপিচুপি বলে দেয় বলেই তো মুহিব ক্লাসে ভালো ছাত্র বনে যায়। এমন বন্ধুকে মুহিব কেন ঈর্ষা করবে, যে তার সব গুণ মুহিবকে সাহায্য করতে ব্যবহার করে যাচ্ছে। সে তো আর জিমির মতো স্বার্থপর নয়।
৭
তারপর একদিন খুব ভোরবেলায় মুহিবের ঘুম ভেঙে যায়, বাইরে তখনও অন্ধকার। ফজরের আজানও হয় নি। বিছানায় তার পাশের জায়গাটা ফাঁকা। সেখানে জিমি ঘুমায়। বিছানাটা ছোট বলে তাদের মা পাশের ঘরটিতে তাদের চাচাতো বোন লিপির সাথে ঘুমায়। মুহিব ভাবল, জিমি মাকে উঠিয়ে টয়লেট সারতে গেছে বাইরে। সে একা বাইরে যেতে ভয় পায় বলে, আগে পাশের ঘরের জানালা দিয়ে মাকে ডেকে উঠিয়ে তারপর যায়। কিংবা, মুহিবকে ঊঠিয়ে নিয়ে যায় কোনো কোনো দিন। মুহিব সেসব দিনেই নিজে যেতে সাহস করে, যেদিন চোখ মেলে তার বন্ধুকে বিছানার আশেপাশেই কোথাও বসে থাকতে দেখে। বন্ধুটির সাথে মুহিবের ভোর রাত্রে পুরো গ্রামে চক্কর দিয়ে আসতেও কোনো ভয় হবে না। কিন্তু জিমি যদি মাকে উঠিয়েও বাইরে যায় সেক্ষেত্রেও মুহিবের ঘুম থেকে জেগে উঠতে হয়। কারণ, জিমি প্রথমে তাকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাতে সফল না হলে তবেই পাশের ঘরের জানালায় গিয়ে মাকে ডাকে। আর জিমি ঘুমায় বিছানার ভেতরের দিকে। বাইরে যেতে হলে মুহিবকে ডিঙ্গিয়ে তাকে যেতে হয়। তাতেও তার ঘুম ভেঙে যায়।
কিন্তু সেদিন মুহিবের ঘুম ভাঙে নি। যখন ভেঙেছে তখন পাশে জিমি নেই আর তাদের ঘরের দরজাটা খোলা। জিমির ফেরত আসার জন্য শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করতে করতে তার আবার ঘুমিয়ে পরার উপক্রম হয়। চোখ লেগে আসার আগে আগে সে ঘরের দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে তার বন্ধুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, বাইরের দিকে মুখ করে। বন্ধুকে দেখে সে ওঠে পরে বিছানা থেকে। বন্ধুটি বলে, “উঠলে কেন? ঘুমিয়ে পর।“
“জিমি বাইরে গেছে।“
“তো? চলে আসবে। তোমার সকালে স্কুল আছে। একটু পরেই উঠতে হবে। ঘুমিয়ে পরো গিয়ে।“
মুহিব তবুও দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সে নিজেও তলপেটে চাপ অনুভব করে। বাইরে যাওয়ার উপক্রম করতেই বন্ধুটি হাত ধরে বলে,
“কোথায় যাচ্ছ?”
“বাথরুম সারতে।“
বন্ধু হাত ছাড়ল না। কিছুক্ষণ মুহিবের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো, “এখন বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। ঘুমাতে যাও। দরকার হলে ঘরের কোণায় পেশাব করে ফেলো। মাটির ঘর, দেখতে দেখতে শুকিয়ে যাবে।“ এরকম কথা শুনে মুহিব ভারী অবাক হয়। কিন্তু তর্কে যাওয়ার সাহস করল না। কখনোই করে না। কথা আর না বাড়িয়ে সে বিছানায় ফিরে আসে। ঘুমানোর চেষ্টা করতে করতে হঠাৎ তার মনে হলো, জিমি বাথরুমে যায় নি। সে পুকুরের পাড়ে আছে। কেন তার সেটা মনে হলো সে জানে না। কিন্তু তথ্যটার সত্যতা নিয়ে তার মনে কোনো সন্দেহই থাকে না। বন্ধুটিকে দরজার চৌকাঠে ঠায় দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে দেখতে মুহিব ঘুমিয়ে পরল।
তার ঘুম ভাঙল মায়ের চিৎকার-চেঁচামেচিতে। চোখ খুলে সে কিছুক্ষণ বুঝতে পারে না কি হচ্ছে! তারপর হুঁশ ফিরে পেয়ে সে দৌড়ে গেল বাড়ির উঠানে। সেখানে রাজ্যের মানুষ ভীড় করে আছে। তারা মাকে গোল করে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের কোলে জিমি। আপাদমস্তক ভেজা, হাত নেতিয়ে আছে। তার সুন্দর চুল বেয়ে তখনও টুপ টুপ করে পানি পরছে। মুহিব তখন ছোট হলেও বুঝতে পারল জিমি বেঁচে নেই। তার ইচ্ছা করল দৌড়ে মার কাছে যেতে, কিন্তু তার বদলে তলপেটের চাপ কমে একটা ক্ষীণ ধারা তার হাঁটু বেয়ে নেমে আসল। অনেকের নজরই তখন মুহিবের দিকে চলে গেল। একটু মায়ের কোল থেকে যখন জোর করে জিমিকে আলাদা করার প্রাণান্ত চেষ্টা করা হচ্ছিল, তখন কয়েক মুহূর্তেরজন্য মুহিব তার বন্ধুকে দেখতে পেল। ভীড় থেকে দূরে একটা পেয়ারা গাছের নিচে উদাস মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মুহিবের চোখে চোখ পরতে একটু হাসল। সহৃদয় সুন্দর হাসি।
গ্রামের বাচ্চারা সাধারণত পানিতে ডুবে মারা যায় না। কিন্তু সে আট দশ বছরের বাচ্চাদের হিসাব। জিমির বয়স ছিল মাত্র পাঁচ। ওই বয়সেই পুকুর পাড়টির প্রতি বাচ্চাটার ভীষণ আকর্ষণ ছিল। গভীর প্রাচীন পুকুর। অত্যন্ত পিছল ঘাট তার। ইদানীংকালে সেই পুকুরে কেউ গোসল করত না বা থালা-বাসন, কাপড়-চোপড় ধুত না। তার জন্য টিউবয়েলের পাড় আছে। মুহিবদের দাদাবাড়িতে গোসল করার জন্য বাথরুম তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাতে মোটর দিয়ে পানি উঠত। তাই মেজো চাচার তেলাপিয়া মাছ চাষ আর বাড়ির বাচ্চাদের সাঁতার শেখা ছাড়া পুকুরটির আর কোনো ব্যবহার ছিল না। জিমির তখনো সাঁতার না শেখা, অতো সকালে গ্রামের কারো পুকুরের আশেপাশেও না থাকা আর সব কিছুর প্রতি তার অশেষ কৌতুহল থাকা- সব কিছুই এক সাথে ঘটে জিমির প্রাণ চলে গেল। পানিতে ডুবে এরকম কতো মানুষ, কতো বাচ্চাই তো মারা যায়- তাই কেউ জিমির মৃত্যুতে শোক আর কিছুই প্রকাশ করে নি। বিস্ময় তো নয়ই।
অবাক শুধু হয়েছিল মুহিব। মৃত্যুর ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা নয় বছর বয়সী কাটার জন্য কঠিন কিছু না। কিন্তু বিস্ময়ের দমকটা তার একা হজম করতে বড়ই কষ্ট হচ্ছিল। ওই রাতে মুহিবের যে মনে হয়েছিল, জিমি বাথরুমে না পুকুরের পাড়ে গিয়েছে এতো বড় বিষয়টা সে কাকে বুঝিয়ে বলবে ঠিক বুঝতে পারছিল না। তার বন্ধু ছাড়া কারো সাথেই তার সেরকম ভাব নেই। তার ইদানীং মাকে দেখলে তার ভয় করে কেমন জানি। তিনি ভারী অন্যরকম হয়ে গেছেন জিমি মারা যাওয়ার পর থেকেই। আর ভীতিকর। কারো সাথে কথা বলেন না, চুপচাপ নিজের কাজ করে যান। কাঁদেনও না আর, চোখের নিচে সবসময়ই গাঢ় কালি পরে আছে। মুহিব ছোট হলেও বুঝত, আর যাই হোক মার সাথে এ নিয়ে কথা না বলাই ভালো।
কিন্তু বড় বিপদেই সে পড়েছিল। বন্ধুটির দেখা নেই জিমির মারা যাওয়ার সেই দিনটি থেকে। কি করবে সে! নয় বছরের বাচ্চার পক্ষে গোপনীয়তার চাপ সহ্য করা সহজ না। তাই সে একদিন তার লিপি আপাকে বলে দিল ব্যাপারটা। লিপি তার চেয়ে বেশ বড়, প্রায় পনের বছর বয়স। একারণেই মুহিবের তাকে বেশ সমঝদার বলে মনে হতো। এছাড়া মুহিবের মনে হতো, এবাড়িতে লিপি আপাই একমাত্র যে তাকে আর জিমিকে সমান সমান ভালোবাসত। এমনকি মাকেও এব্যাপারে মুহিব পক্ষপাতদুষ্ট মনে করত।
লিপিকে খুব বেশি গুছিয়ে মুহিব কিছু বলতে পারে নি।মুহিবের যে তার বন্ধু্র কথা কাউকে জানানো উচিত না, এব্যাপারটা সে নিজে নিজেই বুঝে গিয়েছিল। কেমন করে বুঝল সে জানে না। কিন্তু এব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। তারচেয়ে বড় কথা, এই বিষয়টা নিয়ে কারো সাথে কথা বলতে তার কখনো ভেতর থেকে ইচ্ছাই জাগে নি। বরং উল্টো মনে হয়েছে ব্যাপারটা গোপন রাখা উচিত । তাই লিপিকে বলার সময় মুহিব পুরো ঘটনায় বন্ধুর ভূমিকা একেবারে এড়িয়ে গেল। শুধু বললো, ওই রাতে ঘুমের মধ্যে তার মনে হয়েছিল জিমি পুকুর পাড়ে গিয়েছে।
লিপি বিষয়টা হেসে উড়িয়ে দেয় নি। সে গ্রামে বড় হওয়া মেয়ে। তার কাছে এসব রহস্যময় বিষয় সত্যিকার অর্থেই রহস্যময়। সেই রহস্যে ভেদ করার মতো কিছু নেই। একদিনের মধ্যেই পুরো বাড়িতে রটে গেল, মুহিব স্বপ্নে ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। সবাই তার দিকে অন্যরকম অথচ সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল, শুধু মা ছাড়া। তার এক ছেলে যেখানে মারা গেছে, সেই জায়গা অন্য ছেলে স্বপ্নে দেখেছিল- তাতে কি আসে যায়! ছেলে তো আর ফেরত আসবে না। কিন্তু সবার মুখে স্বপ্নে ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতার কথা শুনতে শুনতে মুহিব সত্যিই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, তার এই ক্ষমতা আছে। তার এটাও দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হলো যে, ওইদিনের পুরো ঘটনা স্বপ্নে ঘটেছিল। স্বপ্নেই সে ঘুম থেকে জেগে উঠেছিল। স্বপ্নেই বন্ধুকে দেখেছিল। স্বপ্নেই বন্ধুর সাথে তার সেই অদ্ভুত কথোপকথন হয়েছিল। আগে বেশিরভাগ সময় সে স্বপ্ন মনে রাখতে পারত না। ঘুম থেকে ওঠার সাথে সাথে ভুলে যেত। কিন্তু তার স্বপ্নের অন্যরকম গুরত্ব আছে, এটা বিশ্বাস করতে শুরু করার পর থেকেই সে ঘুম থেকে ওঠার পর প্রাণপনে তার স্বপ্নগুলো মনে করার চেষ্টা করত। বেশিরভাগ সময়েই পারত না। যেদিন পারত সেইদিন একটা খাতায় স্বপ্নের ঘটনাগুলো লিখে ফেলার চেষ্টা করত। কিন্তু দুই-তিনদিনের বেশি সেটা সম্ভব হয় নি। তার স্মৃতিশক্তি খুব একটা জমজমাট না। তাছাড়া লিখতেও আলসেমি লাগে। বন্ধুকে ছাড়া সে খুবই সাধারণ একটা ছেলে।
শুধু একটা দৃশ্য সে প্রতিরাতেই স্বপ্নে দেখত। যেটা বাস্তবে ঘটে যাওয়ার কোনো সম্ভবনাই ছিল না। তাই একদম নিখুঁতভাবে মনে রাখতে পারার পরও সে কখনো তার সেই স্বপ্ন খাতায় লিখে রাখে নি। সে দেখত- জিমি বাড়ির উঠোনটার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অনেক মানুষ, তারা উচ্চস্বরে কথা বলছে। কিন্তু সে দিকে জিমির কোনো মনোযোগ নেই। সে সোজাসুজি তাকিয়ে আছে মুহিবের দিকে। তার চুল বেয়ে মাথা থেকে টপটপ করে পানি পরে মাটি ভিজে যাচ্ছে।
৮
বিদ্যুৎ চলে এসেছে। কিন্তু মুহিবের ভেতরে সেই ভীত ইচ্ছেটা আর জেগে উঠছে না যে তাকে কম্পিউটারের সামনে গিয়ে বসতে হবে, নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে যাতে মাথার ভেতরে সে জেগে না ওঠে, যার সাথে মুহিবের জেতার কোনো ইতিহাস নেই। তাই তার মুখোমুখি না হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা সে করেছে বছরের পর বছর। কিন্তু আজ যে সে এতো বছরের পাওনা না চুকিয়ে যাবে না, তাতে মুহিবের কোনো সন্দেহ নেই। মুহিবের সাথে সাথে সেও বড় হয়েছে। শক্তিতে, বুদ্ধিতে। মুহিব তার সাথে পাল্লা দিতে পারবে না। তার সেই ক্ষমতা নেই। তাই সে শান্ত হয়ে বসেই রইল, ডাইনিং টেবিলে।
চারদিক আলোকিত হওয়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অবশ্য বাসার কলিংবেল বেজে ওঠল। মা এসেছে। বাড়িতে ফিরে মাকে তার যতখানি দরকার বলে মনে হয়েছিল, এখন বুঝতে পারছে সেই দরকার আর নেই। সে ইতোমধ্যেই পরাজিত। মুহিব তাই আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে দরজা খোলে। একটু অবাক হলো একজন ভদ্রমহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। আটপৌড়ে সালোয়ার-কামিজ পরা, মধ্যবয়সী। প্রথমটায় সে চিনতে পারল না। ভদ্রমহিলা যখন হাসলেন, তখন চিনতে পারল। নাসরিনের মা। ইনি মিষ্টি নিয়ে বাসায় এসেছিলেন। তার আগেও দু-একবার বাসায় ফিরে মায়ের সাথে ওনাকে গল্প করতে দেখেছে মুহিব। তখন কুশল বিনিময় হয়েছে।
“তুমি আমাদের বাসায় গিয়েছিলে?”
মুহিব দারুন নার্ভাস হয়ে গেল। যদিও বাইরে সেটা প্রকাশ করল না। সংক্ষেপে বলল, “হ্যাঁ’।
ভদ্রমহিলা হেসে বললেন,”নাসরিন তোমাকে চিনতে পারে নি। তাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তুমি কিছু মনে করো না, কেমন?”
মুহিব স্বস্তির শ্বাস ফেলে ভদ্রতার হাসি হাসল।
ভদ্রমহিলার হাতে যে একটি মোবাইল ফোন ছিল, মুহিব সেটা খেয়ালই করে নি। তিনি ফোনটা মুহিবের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “কাউকে বোধ হয় ফোন দিতে চেয়েছিলে। আমার ফোন ইউজ করতে পারো দরকার হলে।“
হ্যাঁ, মায়ের খোঁজ নেওয়া প্রয়োজন আসলেই। বেশ রাত হয়ে গেছে, আর বৃষ্টিও থেমে গেছে। এতোক্ষণে চলে আসার কথা তার, যেখানেই গিয়ে থাকুন না কেন। মুহিব ভদ্রমহিলার কাছ থেকে ফোনটা নিল। এতো চমৎকার আচরণের পর একেকজন মানুষকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখানো চলে না। মুহিব দ্বিধার সাথে বলল, “আন্টি আপনি ভেতরে এসে বসুন। আমি ততোক্ষণে কথা বলে নিই মায়ের সাথে। অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই মাকে বাসায় দেখছি না। “
তাদের বাড়িতে ড্রয়িং রুম নেই। বাসায় অতিথিও বলতে গেলে কেউ আসে না। হুট-হাট পড়শীরা কেউ চলে এসে ডায়নিং টেবিলেই বসতে দেওয়া হয়। এজন্য ডায়নিং রুমটা সবসময় ঝকঝকে করে রাখে মা। তবে ভদ্রমহিলাকে নিয়ে মুহিব যখন ডায়নিং রুমে ঢুকল তখন তার মনে হলো, রুমটাকে বেশ হতচ্ছাড়া দেখাচ্ছে আজ। টেবিলের উপর কয়েকটা ভাত পরে আছে, প্রায় শেষ হয়ে আসা মোমবাতিটা কাত হয়ে পরে আছে টেবিলের মাঝখানে, ঘরে উজ্জ্বল আলোটার বদলে ডিমডিমে মন খারাপ করা বাতিটা জ্বলছে। তার উপর একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে টেবিলের উপর দুই পা তুলে বসে আছে লোকটা। মুখে মিটিমিটি একটা হাসি, যেন মুহিবের বিব্রত ভীত অবস্থা দেখে তার খুব মজা লাগছে। আন্টি এতো কিছু লক্ষ্য করল না। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পরে বললেন,”তোমার ফোন হারিয়ে ফেলেছ বুঝি?”
মুহিব হতাশভাবে মাথা নাড়ল। লোকটা আনন্দের হাসি হাসল।
“আপা, তোমার আম্মা গেছেন কোথায়?”
“আমি ঠিক জানি না আন্টি। বাসায় ফিরেই দেখছি তালা আটকানো, বাইরে থেকে।“ মুহিব মায়ের নাম্বারে ডায়াল করতে করতে ছোট্ট একটা মিথ্যে বলে দিল। কেন বলল, নিজেও জানে না।
ভদ্রমহিলা আর মুহিব দুজনকেই চমকে দিয়ে ফোনটা বেজে ওঠে বাসার ভেতরে কোথাও। মুহিব বুঝতে পারল, বারান্দায় ফোন বাজছে। আন্টি জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় মুহিবের দিকে। মুহিব ইতস্তত করে বলে,”মা বোধ হয় ভুল করে তার ফোন বাসায় রেখে বের হয়ে গেছেন। আপনি বসুন , আমি চেক করে আসছি।“
ভদ্রমহিলার ফোনটা তাকে ফেরত দিয়ে মুহিব বারান্দায় যায়। সেখানে সে কারো সাথে কথোপকথন চালায়। বোঝা যায়, ফোনে কথা বলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মধ্যেই হাসিমুখে ফেরত আসে।
“এই যে আন্টি, মার ফোন। যা ভেবেছিলাম সেটাই। ভুল করে ফেলে রেখে চলে গেছেন।“
আন্টি উদ্বিগ্নভাবে বলে, “ওমা! তাহলে এখন ওনার খোঁজ নিবে কীভাবে!”
“সমস্যা নেই আন্টি। মা আমার নানাবাড়ি গেছে।“
“ওহ! তাই না কি? বুঝলে কীভাবে?”
“আমার নানীর নাম্বার থেকে অনেকগুলো মিসকল এসে জমা হয়ে ছিল। ফোনব্যাক করলাম এইমাত্র। মা ফোন ধরল। বলল, ফোন রেখে চলে গেছেন। সারাদিন ফোন দিয়েছে আমার নাম্বারে, তার নাম্বারে। আমার নাম্বার বন্ধ। আর তার নাম্বার এনগেজড দেখাচ্ছিল। তাই সন্ধ্যার পর আর ফোন দেয় নি।“ মুহিব মিষ্টি হেসে গুছিয়ে সুন্দর করে বলে।
আন্টি রাগত ভাবে বলল, “হ্যাঁ আর বোলো না। মোবাইলের নেটওয়ার্ক এতো সমস্যা করে। ফুল নেটওয়ার্ক দেখায়, অথচ কল ঢোকে না। আমার সাথে কত হয়েছে এমন।“
“আমার মামা হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে গেছেন। তাই ইমার্জেন্সি যেতে হলো মা কে। সারাদিন খুব টেনশনে ছিলেন মা। কাল আমিও চলে যাব আমার নানাবাড়িতে। অফিসে ছুটি পাওনা আছে। কাল নিয়ে নেবো।“
“হ্যাঁ ঘুরে এসো। মায়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে, এসময় যতো সঙ্গ দাও ততো ভালো। খুব ভালো মানুষ তোমার আম্মা। তাছাড়া আত্মীয়দের বিপদে পাশে থাকতে হয় সব সময়।“ আন্টি চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন।
“আরেকটু বসেন, চা বানাই।“
“আরেহ না বাবা। এতো রাতে চা খেলে একেবারেই ঘুম আসবে না রাতে।“ পরে দুঃখের সাথে বললেন, ”তোমার ফোনটা হারিয়েই গেল তাহলে। দামী ছিল?”
“খুব দামি না আন্টি। এজন্যই গায়ে লাগছে না।“
“কোথায় হারালে? টের পেয়েছ কিছু?”
“হ্যাঁ আন্টি, অফিসে যাওয়ার সময়েই বাসে কেউ পকেট থেকে তুলে নিয়েছে। তারপর বন্ধ করে দিয়েছে। এজন্যই মা সারাদিন ফোনে পায় নি আমাকে।“
“ইসস! বাসে খুব সাবধানে চলতে হয় এজন্যই।“ আন্টি দরজার ছিটকিনি খুলে বাইরে চলে গেলেন।
“আবার আসবেন আন্টি।“ মুহিব আন্তরিকতার সাথে বলে দরজা লাগিয়ে দিল।
তারপরই সে দরজায় হেলান দিয়ে বসে পরে। তার দুপায়ে আর কোনো জোর নেই।
৯
মুহিব মায়ের ঘরের বিছানায় বসে আছে মাথা নিচু করে। ঘরটায় সবই ঠিকঠাক। দেয়ালে নীল পেইন্ট, একটা ছোট কাঠের আলমারী, একটা মাঝারি সাইজের আয়না দেয়ালে আটকানো। মাঝারি সাইজের ঘরটার মাঝখানে মায়ের খাটটা। তারই এককণায় মুহিব বসে আছে। তার মেরুদন্ড বাঁকা হয়ে মাথাটা প্রায় হাঁটু ছুঁয়ে ফেলেছে, সেই অবস্থাতেই হাতে সে নিজের মাথার চুল খামচে ধরে আছে। বুক ফাটানো একটা কান্না সে প্রাণপনে গিলে ফেলার চেষ্টা করছে। খুব একটা লাভ হচ্ছে না তাতে, কান্নার শব্দটাই চাপা পরছে শুধু; এছাড়া শোক,বেদনা, ক্ষোভ সবকিছুই মুহিবের শরীর গলে কান্না দিয়ে বের হয়ে আসছে।
লোকটা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মুহিবকে ডুকরে ডুকরে ওঠতে দেখছে। তার চোখেও গভীর বেদনা, পানিতে ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ। সে মুহিবের উপর থেকে চোখ সরিয়ে বিছানায় পরে থাকা মায়ের দিকে তাকালো। একদম সোজা হয়েন শুয়ে আছে্ন মা। শোনা যায়, মৃত মানুষকে দেখলে মনে হয় ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু মা কে দেখলেই বোঝা যায়, তিনি মৃত। ঠোঁট দুটো অল্প খোলা, চোখ দুটো সম্পূর্ণ খোলা, আর গলায় হালকা বেগুনি রঙের দাগ। তার চেহারা মৃত নয় এখনো, সেখানে অনুভূতির ছাপ আছে। ভয়। মুহিব ফোঁপাতে ফোঁপাতে মায়ের উপর ঝুঁকে পরে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। তারপর প্রায় পশুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের এক কোণায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদতে থাকে। সে মায়ের মাথার কাছে বসে মুহিবকে দেখতে থাকে, শান্তভাবে।
বাইরে আবার বৃষ্টির তোড়জোড় শুরু হয়েছে। মুষলধারে বর্ষণের প্রবল শব্দের কারণেই মুহিব হাউমাউ করে কিছুক্ষণ কেঁদে নিতে সাহস করে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না, আবার সবই কেমন যেনবুঝতে পারছে বলে তার হলো। ঠিক যেমন, সে বুঝতে পেরেছিল জিমি পুকুরের পাড়ে আছে। কতক্ষণ এভাবে সে পরে থাকত জানে না। কিন্তু বজ্রপাতের প্রচন্ড শব্দে স্তম্ভিত ফিরে পেয়ে সে চোখ মুছতে মুছতে ওঠে বসে। লোকটা এর মাঝেই কখন ওঠে গিয়ে মোমবাতি, লাইটার আর সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে হাতের কাছে রেখেছে। মুহিবকে ওঠে বসতে দেখে নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে তার দিকেও একটা সিগারেট আর লাইটার ছুড়ে দিল। মুহিব শান্ত ভঙ্গিতেই সিগারেট ধরাল।
একটা লম্বা টান দিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে খাকাড়ি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল। মনে হলো কিছু একটা বলবে। কিন্তু বলল না। চুপচাপ সিগারেট টানতে থাকে। সিগারেট যখন শেষ দিকে তখন মুহিব আরেকবার লোকটার দিকে তাকালো। সে এখন মেঝেতে মুহিবের মুখোমুখি এসে বসেছে, হাঁটু ভাজ করে, সামান্য দুরত্বে।
মুহিব স্পষ্ট গলায় প্রশ্ন করে, “কেন?”
লোকটা আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল, “আমার তো জানার কথা না মুহিব। তুমি যখন এই কান্ড করেছ, তখন আমি ছিলাম না এখানে।“
“মিথ্যা কথা।“ মুহিব খুব শান্তভাবে বলার চেষ্টা করে। পারে না, কান্নায় তার গলা ভেঙে আসছে। “আমি মাকে মারিনি। আমি একাজ করতে পারি না। সব কিছু তুমি করেছ। তুমি মাকে মেরে ফেলেছ, তুমি জিমিকে মেরে ফেলেছ ।“
ভারী অদ্ভুতভাবে হাসল লোকটা। ছেলেমানুষী কথা শুনলে বড়রা যেভাবে হাসে। “জিমিকে যদি আমিই মেরে থাকি, তাহলে তুমি কীভাবে জানলে ও পুকুরের পাড়ে আছে?“
মুহিব দুহাতে হাত হাঁটু জড়িয়ে ধরে ফোপাতে ফোপাতে ভাঙা রেকর্ডের মতো বলতে থাকে, “না না না না না…”
লোকটা হতাশভাবে মাথা নাড়ল। তারপর অকারণেই ফিসফিস করে বলল, “তুমি খুব বড় বিপদে আছ মুহিব। আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই । লাশ সরিয়ে ফেলতে হবে। তারপর এখান থেকে তোমার পালাতে হবে। এসব নিখুঁতভাবে গুছিয়ে করার ক্ষমতা তোমার নেই বলেই তুমি আমাকে ডেকে এনেছ। ভেবে দেখ।“
মুহিব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। যেন বুঝতে পারে না কি বলছে।
“আজকের দিনটা তুমি খুব ভেবেচিন্তেই বেছ নিয়েছ মুহিব। তুমি জানতে তোমার বন্ধুরা আজ কেউ থাকবে না। ফোনটা তুমি নিজেই ছেড়ে এসেছ চায়ের দোকানের বেঞ্চের উপর। আমার আসাটা তুমি পাকা করতে চেয়েছ নিজেই। এতোগুলো বছরের অনভ্যাস কাটাতে কিছু আয়োজন তো করতেই হবে।“
“আর বৃষ্টি বুঝি আমিই ডেকে এনেছি? বিদ্যুৎ বুঝি আমার ইচ্ছাতেই চলে গেছে যাতে আমি কম্পিউটার ব্যবহার করতে না পারি?” মুহিব ভাঙা গলায় মরিয়া হয়ে তর্ক করার চেষ্টা করে।
“বৃষ্টি হলেই এই এলাকায় দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎ থাকে না, সে তো নতুন কিছু নয়। রাস্তায় যখন বৃষ্টি এসেছিল, তখনই তোমার বোঝা উচিত ছিল বিদ্যুৎ বিদায় নিতে যাচ্ছে।“
মুহিব বিড়বিড় করে বলে, “আমি মার কথা ভেবে বাসায় এসেছিলাম। আমি তো আর জানি না এর মধ্যে তুমি তাকে খুন করে ফেলেছ…”
তার মুখে সহৃদয় হাসিটা ফিরে এলো। “তুমি ঠিকই জানতে মুহিব মা নেই, এবং সে আর আসবেও না। মায়ের ফোন পুরোটা সময় তোমার পকেটে ছিল। তুমি বারান্দায় শুকাতে দেওয়া তোমার প্যান্টের পকেট থেকে মার ফোন বের করেছ।“
মুহিব চুপচাপ বসে থাকে।
“ওঠো মুহিব, কাজে লেগে পড়তে হবে। ভাগ্য ভালো আমাদের, আজ জোড় বৃষ্টি হচ্ছে। বাসার ভেতরের কোনো শব্দ বাইরে যাবে না।“
মুহিব টলতে টলতে মার বিছানার দিকে আগায়। বিছানাটার বাম পাশের দেয়ালে লাগানো আয়নাটার সামনে এক মুহূর্ত দাঁড়ায় সে। সবকিছু কেমন যেন কুয়াচ্ছান্ন লাগতে শুরু করে তার কাছে। নিজের চেহারা আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পারছে না সে, তার পেছনে এসে দাঁড়ানো লোকটার চেহারা তো আরো দেখতে পারছে না। শুধু তার কণ্ঠস্বর শুনতে পারছে। “ভালো কথা, ওয়েদার টেলিকাস্ট থেকে তুমি আগে থেকেই জানতে আজ খুব বৃষ্টি হবে, তাই না? মুহিব, তুমি বোকা নও একেবারেই। তুমি আমার মতোই চালাক, শুধু তুমি আমার চেয়ে ভীতু। এছাড়া আমরা দুজন কিন্তু একইরকম।“ লোকটার প্রাণহীন হাসি শুনতে পেল সে।
সবকিছু আরো ঘোলাটে দেখাচ্ছে। এ অবস্থাতেও মুহিব নিজের বাম গালে বহু পরিচিত, বহু পুরোনো ক্ষতর দাগটা দেখতে পায়। তিনটে ছোট ছোট গোল কালচে দাগ, প্রায় এক লাইনে। কিন্তু ভালো করে দেখলে বোঝা যায় মাঝের কালো দাগটা অন্য দুটির চেয়ে সামান্য উপরের দিকে। প্রায় ত্রিভুজের তিন বিন্দুর মতো। এই ক্ষতচিহ্নটাই বহু বছর পরেও মুহিবকে মনে করিয়ে দিত অনেকদিন আগেকার একদিনের কথা।
১০
জিমি মারা যাওয়ার প্রায় মাসখানেক পর। মা ছাড়া বাড়ির প্রত্যেকেই স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছে। সঙ্গীর অভাবে মুহিব প্রথম প্রথম খুব অস্থির হয়ে থাকত। জিমি নেই, তার বন্ধু নেই। কিন্তু স্বপ্নে তার ভবিষ্যত দেখতে পাওয়ার খবরটা ছড়িয়ে যাওয়ার পর গ্রামের সমবয়সী কিছু ছেলে যেচে তার সাথে খেলতে আসে। প্রথমে তাদের মতলব ছিল, মুহিবের সাথে ভাব করে নিজেদের দেখা স্বপ্নের অর্থ জানতে চাওয়া। মুহিব কোনো সময়েই খুব ভালো উত্তর দিতে পারত না, কিন্তু যাই বলত বাচ্চাগুলো তাই শুনেই তার দিকে মহা শ্রদ্ধার চোখে তাকিয়ে থাকত। আস্তে আস্তে ওরা মুহিবের বন্ধুই হয়ে ওঠে। স্কুলেও তারা একসাথে যায়, মুহিব আর আগের মতো একা একা থাকে না, বাড়ি ফিরে বই-খাতা রেখে খেলতে চলে যায়। কিন্তু একটা জিনিস সে আগের মতোই করে। সন্ধ্যার একটু আগে আগে বাড়ীর পেছনের বাগানটাতে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। নতুন যতোই বন্ধু তার হোক, পুরোনো রহস্যময় বন্ধুটির আকর্ষণ সে ছাড়তে পারে নি।
বাগানে এভাবে দশ-বারোদিন ঠায় অপেক্ষা করার পর একদিন বন্ধুটি এলো। সেদিনের কথা মুহিব মনে করতে পারে আজো। সারাদিন সে অন্য কোনো বন্ধুর সাথে দেখা বা খেলা করে নি। কারণ খুব বৃষ্টি হচ্ছিল, গ্রামে বাচ্চারা বৃষ্টি হলে খুব হুল্লোড় করে খেলে। কিন্তু মুহিবের সেদিন একেবারেই কারো সাথে কথা বলার ইচ্ছা করছিল না। স্কুলেও যায় নি সে, সকাল থেকে চুপচাপ ঘরে বসে আছে। বিকালের দিকে বৃষ্টি কমে গেল বিধায় সন্ধ্যায় সে বাগানে গেল। তখন বৃষ্টি নেই, কিন্তু গাছ-পালায় জমে থাকা পানি বাতাসে ধাক্কা খেয়ে ঝিরঝির করে পরছে। ভেজা বাতাস আর গায়ে অল্প অল্প পানির ছিঁটে নিয়ে মুহিব বাগানে একটা আম গাছের নিচে অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বন্ধুটি এলো একসময়। কিন্তু মুহিবের মতো সে অনেকদিন পর মোলাকাতের আবেগে অভিভূত না একেবারেই। আর অবাক করা ব্যাপার হলো, তার হাতে একটা কাঁটাচামচ। ভুরু কুঁচকে ঠান্ডা গলায় সে জানতে চাইল কেন মুহিব সবাইকে বলে বেড়িয়েছে যে তার মনে হয়েছিল কিংবা সে স্বপ্নে দেখেছে যে জিমি পুকুরের পাড়ে আছে?
মুহিব ভারী অবাক হয়ে গেল। এতে এতো রাগ করার কি আছে। সে তো সত্যিই স্বপ্নে দেখেছে ওটা। বন্ধু মুহিবের ব্যাখ্যা শোনার জন্য অপেক্ষা করল না। নীরবে অথচ হিংস্রভাবে হাতের কাঁটাচামচটা মুহিবের বা গালে গেঁথে দিল। মুহিব সেদিন যন্ত্রণায় চিৎকার কেন করে ওঠে নি সে নিজেও জানে না। কাঁটাচামচটা তার গালের মাংস ভেদ করে মাড়িতে গিয়ে ঠেকেছিল। যে কোনো হিসাবেই বড় জখম। কিছু সে চিৎকার করে নি। কাঁটাচামচটা টান দিয়ে বের করে সেটা এক হাতে নিয়ে আরেক হাত গালে চেপে চুপচাপ ঘরে ফিরে এসেছিল। মাকে দেখাতেই তিনি চিৎকার করে হইচই শুরু করে দিলেন। দাদা মুহিবকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করেছিলেন, কি করে হোলো? মুহিব সংক্ষেপে বলে, ঘুমের মধ্যে লেগে গেছে। সেটা কীভাবে সম্ভব, কেউই এব্যাপারে বেশি প্রশ্ন করে নি মুহিবকে। ছেলেটার স্বপ্নের মতো ঘুমও রহস্যময়। হতেই পারে। তার প্রতি সবার সম্ভ্রম আরো বেড়ে গেল।
কিন্তু এরপর থেকে মুহিবের একটা পরিবর্তন বাড়ির মানুষেরা লক্ষ্য করে। জিমি মারা যাওয়ার পর থেকে সে সমবয়সীদের সাথে মিশতে শুরু করেছিল সত্য, কিন্তু এখন সে অতিরিক্ত সামাজিক হয়ে গেল। সবসময়েই কারো না কারো সাথে হয় খেলছে, নয়তো কথা বলছে; সমবয়সীরা না থাকলে বড়দের আশেপাশে বসে আছে, তাদের সাথে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে। আর কিছু না হলেও অন্তত কারো না কারো সাথে থাকছে। প্রথমে সবাই ভেবেছিল, জখম হওয়ার পর ছেলে একা থাকতে ভয় পাচ্ছে। আস্তে আস্তে সবাই ভুলে যেতে শুরু করল, মুহিব নিজের মনে একা একা থাকতে পছন্দ করা ভাবুক ধরনের একটা বাচ্চা ছিল। তার এই পরিবর্তনই একসময় স্বাভাবিক হয়ে গেল সবার কাছে। শুধু মুহিব জানে তাকে কত কষ্ট করে মানুষের আশেপাশে থাকার এবং কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়ার এই অভ্যাস অর্জন করতে হয়েছে। ভয় পেলে মানুষ অনেক কঠিন কাজও খুব অধ্যাবসায়ের সাথে করে ফেলে।
১১
মুহিব জিমিকে দেখছে আগের মতোই। দাদাবাড়ির বিশাল উঠানটার ঠিক মাঝখানে ভেজা শরীরে সে দাঁড়িয়ে। তার মাথার চুপ বেয়ে পানি পড়ছে। টপটপ টপটপ…। তবে আজ তাকে ঘিরে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে নেই। আজ কেউ উচ্চস্বরে কথা বলছে না। দূরে পেয়ারা গাছের নিচে শুধু একজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে মনে হলো মা, তারপর মনে হলো ওই লোকটা, তারপর মনে হলো সে নিজেই…।