পাতাল ভ্রমণ – শহিদুল আলম
ভেজানো পাল্লার ফাঁক গলে শীতের অন্ধকার আর নৈঃশব্দ চোয়ানো ঠাণ্ডা বাতাস তির তির করে ঘরে ঢুকছে। মশারি উঁচু করে বইটা টেবিলে রেখে দিই।
মাথার কাছেই জানালা। কতোবার চিপ দিলাম, থাকে না, পড়ে যায় আর ঠাণ্ডা বাতাস সুঁচের মতো বিদ্ধ করে কম্বলের সমস্ত ওম্ কেড়ে নেয়।
এসব ছাড়িয়েও অনেকক্ষণ আমার সমস্ত অনুভূতি জুড়ে রাজত্ব করে সদ্যপঠিত উপন্যাসের নায়ক রাসকলনিকভ। দুই মহিলাকে খুন করে ওভারকোটের ভেতর রক্তমাখা কুড়ালটা লুকিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ে পালাচ্ছে ও…কে
আশ্চর্য এক অপরাধী। প্রায়শ্চিত্তের দাহে পীড়িত হতে হতে কখোন আমার সামনে এসে দাঁড়ায় লোকটি; এক মানবিক ঈশ্বর যেন। ধ্বস্ত, যন্ত্রণাকাতর, অথচ এমন নির্মল, এমন স্বচ্ছ হৃদয় মানুষ- কোথাও দেখিনি।
ঘুম পেয়েছে। ছাই ঝেড়ে বেশ লম্বা একটা টান দিই সিগারেটে। অনেকদিন মালাকে দেখিনি। প্রতিদিন তবু ঘুমোবার আগে ওর একজোড়া ঘন গাঢ় অবদমিত চোখ আমার দিকে চেয়ে থাকে। আজ রাতে ওকে স্বপ্নে দেখব- কাল ঘুমোবো।
এ রকম ভেবে নিতে ক্ষতি কী? সুখী মানুষদের কোনো স্বপ্ন থাকে না। হয়তো প্রেমও। থাক, পরে ভাবা যাবে।
হাত-পা আলগা হয়ে আসে। ছাইসমেত ফিল্টারটা ছাইদানিতে না ফেলে আলস্যে মেঝেতেই ছুঁড়ে দিই।
বেড-সুইচ অফ করে স্বপ্নজড়ানো এই অন্তরঙ্গতাটুকু অনুভব করব ভেবে লেপ মুড়ি দিয়ে অতলে ডুবে যাই। রাত তখন কতো হবে কে জানে। দরজায় অকস্মাৎ কড়া নাড়ার শব্দ ওঠে। এতো রাতে কে? হয়তো হাড়-কাঁপানো রাতে কোনো বিড়াল কিংবা কুকুর ধাক্কা দিয়ে দেখছে দরজাটা বন্ধ না খোলা। নাকি বাতাস, কে জানে।
আবার ধাক্কা!
দরজা খুলে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকি। মূর্তিমান বিস্ময়ে শিহরিত হয়েও বিশ্বাস করতে বাধ্য হই- সামনে মাসুদ। ওর পেছনে আরেকজন ছায়ার মতো, আগে দেখিনি।
‘ও রুবেল, আমার বন্ধু’ মাসুদ বলল, ‘ভেবেছিলাম বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছিস। চল, দেরি করা যাবে না’
একটা ধাঁধার প্যাঁচে জড়িয়ে পড়ি যেন। বস্তু ও স্বপ্নের মধ্যে কোনো বিরোধ থাকা কি অনিবার্য কিংবা দুটোই সমান- বুঝতে পারি না। আজ সকালের সংবাদপত্রে কমলাপুর স্টেশনের পার্শ্ববর্তী এক পতিত ডোবা থেকে ‘একটি যুবকের লাশ উদ্ধার’ শিরোনামের ওপর মাসুদের ছবি ছাপা ছিল। অথচ এখন মাসুদের সামনেই আমি দাঁড়িয়ে আছি। এক আতঙ্কিত কৌতূহলে আমি ওকে পর্যবেক্ষণ করি। গুছিয়ে কিছু যে ভাবছি- তাও না। এই অনাকাক্ষিত বাস্তবতায় নিজের করণীয় সম্পর্কে দ্বিধায় পড়ি। মাসুদ আমার ডান হাত ধরে স্বাভাবিক মানুষের মতো টানে:
আয়। কী ভাবছিস?
না
তো আয়
আমি পথ না-চেনা আনাড়ির মতো ওদের অনুসরু করে পাতলা খান লেনের অন্ধকার গলি পেরিয়ে অপেক্ষাকৃত চওড়া রাস্তায় উঠি। দু’একটি কুকুর নিঃশব্দে ডাস্টবিনের স্তূপীকৃত আবর্জনায় মুখ চুবিয়ে খাবার খুঁটছে। মোড়ে ঝাঁপ বন্ধ করা মুদি দোকানের সামনে পাঁচ-ছটা কুকুর পেছনের পা মুড়ে মুখগুলো ঊর্ধ্বমুখী করে দীর্ঘ প্রলম্বিত স্বরে কখনো একা, কখনো একসঙ্গে বার বার ডেকে উঠছে। দিনের কোলাহলের শেষ চিহ্নটুকুও উধাও। কনকনে ঠাণ্ডা আর কুয়াশা টিউব-লাইটের দুধ-আলোর সঙ্গে মিশে ঝরে পড়ছে অনবরত। রাস্তার ওমাথা দিয়ে একটা প্রাইভেট কার হেড-লাইটের এক ঝলক ফ্যাকাশে আলো ফেলে সোঁ করে বেরিয়ে গেল।
জনহীন শূন্য রাস্তা। তবু মাসুদ বোধ করি বড়ো রাস্তা ধরে খোলামেলা চলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিল না। কুকুরগুলোর পাশ দিয়ে ডানদিকের অপেক্ষাকৃত চিকন ও আবছা শ্রীশ দাস লেনের এক গলিতে ঢুকে পড়লাম আমরা। এখানকার পোস্টে আলো জ্বলছে। রাস্তাটাও বেশ শুকনো। এতো কাছের গলি আমার, তবু কতো অচেনা। বুড়িগঙ্গার প্রান্তবর্তী ঢাকার এই প্রাচীন অংশে জীবন পার করেও কতো গলি আমার অচেনা রয়ে যাবে- ভাবতেই নিজেকে কেমন আগন্তুকের মতো মনে হয়। নিশুতি রাতের এই আলো-অন্ধকারময় পরিবেশে পরিচিত জায়গাও কেমন রহস্যময় লাগে। ভিড়, ধাক্কা, কোলাহল, খিস্তি আর রিক্সা ঠেলাগাড়ির চাপে চ্যাপ্টা চিকন রাস্তার দু’পাশ দোকানের পর দোকান, ব্যবসায়ীদের ব্যস্ততার মাঝে দিনের যে প্রাণবন্ত প্রবাহ- রাতে তার রূপ কত বদলে যায়!
দোকানের শাটারগুলো নামানো, তাতে ছেঁড়াখোড়া আকিজ বিড়ি, রাজা কনডম থেকে নির্বাচনী বিজ্ঞাপনের দীর্ঘ পোস্টার, একটার গায়ে আরেকটা সাঁটা। তার ওপরে পানের পিক চুন কফ আর থুথুর শুকনো দাগ। দোকানগুলোর সামনে সিঁড়িতে বা রকে বন্যা-ঝড়-খরায় ভেসে আসা মানুষ আর কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমের মধ্যে লেপ্টানো। চারদিকে মানুষের কোলাহলহীন নৈঃশব্দের একটা হুহু সূক্ষ স্বর, দিনের বেলায় ঢাকার এই অংশে যা কল্পনা করা যায় না।
সদরঘাটের টার্মিনালগামী প্রধান সড়কে এখনো দু’একটা মানুষের আনাগোনা ক্রস করে রূপমহল সিনেমা হলের উল্টোদিকে হকার্স মার্কেটের ভেতর দিয়ে মায়াকাটরা ছাড়িয়ে মাসুদ আমাদের নওয়াববাড়ির দিকে নিয়ে যেতে থাকে। খাকি কাপড়ের প্রহরীরা কোথায়- চোখে পড়ে না। মাঝে মধ্যে লাইটপোস্টে তাদের ডাণ্ডা পেটানোর শব্দ কাতরানির মতো কানে এসে বাজে।
বুড়িগঙ্গার বুক থেকে অকস্মাৎ একটা হাঁক রাত্রির স্তব্ধতা ভেঙে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। জাহাজের একটানা ইঞ্জিনের আওয়াজ, পানি কাটার শব্দ যেন নদীর ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস!
হকার্স মার্কেট পার হয়ে সিমসন রোডের সামনে উঁচু নিচু বাড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে নওয়াব বাড়ির গোল গম্বুজের মাথাটা ছায়ার মতো একবার চোখে পড়ল। শিশু অশত্থের ডালপালায় ঢাকা পলেস্তরা-খসা কালচে গম্বুজটা কেমন ভুতুড়ে। গা ছমছম করে ওঠে।
ওদিকে না গিয়ে মাসুদ হুট করে এক অদ্ভুত চিকন অন্ধকার গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে।
আমার পা থেমে যায়। থামতে বাধ্য হয়। ড্রেনের উপচানো আবর্জনা সারা গলিতে ছড়ানো। একপাশে ঢাকনা খোলা ম্যানহোল থেকে ভুশভুশ পানি উঠছে। পচা গুমোট গন্ধ ভক্ভক্ করে নাকে এসে লাগে। আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওরা?
খুব সম্ভব অব্যবহৃত গলি এটি। ওদের পেছনে পেছনে সন্তর্পণে কয়েক পা এগিয়েই দেখি পচা পানি ও আবর্জনায় থিক থিক করছে সামনেটা। হাঁটার জন্য একটা করে আলগা ইট পাতা। রুবেল তাতে পা দিয়ে এগোয়। মাসুদ পিছন ফিরে আমাকে ডাকে।
দু’পাশে দুর্গের মতো সারি সারি নওয়াব আমলের বাড়ি। পলেস্তরাশূন্য সরু ইটের স্যাঁতসেঁতে দেয়াল, জানালার সাঁড়াশিগুলো কবে পচে ঝরে গেছে। দু একটা যাও-বা আছে, জোড়াতালি দেয়া, হার্ডবোর্ড দিয়ে ভেতর থেকে বন্ধ। দু’পাশের দেয়ালের মাঝে বড়জোর হাতদেড়েক, হয়তো তাও হবে না, চওড়া এই গলি। এমোনিয়ার ঝাঁ ঝাঁ গন্ধ পেরিয়ে, সঙ্গমবদ্ধ একজোড়া কুকুরের শরীর ছুঁয়ে ওরা আমাকে নিয়ে যায়। আর আমার বাড়ানো ডান পায়ে থপ করে একটা গিঁট বাঁধা উষ্ণ কনডম ওপর থেকে এসে পড়ে। ঘিনঘিন করে সারা শরীর প্রবলভাবে কেঁপে ওঠে আমার।
ও কিছু না, চলে এসো, মাসুদ অভয় দেয়।
ওর দিকে তাকালে ছুরিতে এলোপাতাড়ি কুচিকুচি করা, পচা পানিতে ভাসা, ওর স্বাভাবিক আকৃতি বিলুপ্ত সংবাদপত্রের ছবিটা আমার স্মরণে আসে। অথচ কী আশ্চর্য, এই মুহূর্তে ভয়ের পরিবর্তে এক ধরনের কৌতূহল ভেতরে ভেতরে আমাকে প্ররোচিত করে।
শরীর ঘিনঘিনিয়ে উঠলেও পা ছুঁড়ে আমি জিনিসটা ফেলে দিয়ে ওপরে তাকাই- একটা পুরুষ হাত শিক গলে ভেতরে ঢুকে যায় আর সেই সঙ্গে জানালার ছিটকি বন্ধ করার ছোট্ট শব্দ কানে আসে।
ভ্যাপসা দেয়াল বেয়ে অজস্র আরশোলা ছুটোছুটি করে। বাঁক ঘুরলে আর একটা ঘুটঘুটে গলি। এখানে এসে জায়গাটাকে আমি আর সনাক্ত করতে পারি না। আগে কখনো আসিনি, প্রয়োজনও পড়েনি। একবার মনে হয় ওয়াইজ ঘাটের পেছনে, আবার স্টার হলের পেছন দিক বলেও ভ্রম হয় কখনো। কে জানে। হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় একটা শতভাঁজ হয়ে পড়ে থাকা মৃত অজগরের শরীর বেয়ে হেঁটে যাচ্ছি। কখনো পা দেবে যাচ্ছে তার স্খলিত মাংশের ভেতরে আর তার মাংশের পচন থেকে ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে ঝাপটা মারছে। প্রাচীন সাড়ে তিন তলা একটা বাড়ির ভগ্নস্তূপের ছায়ায় গিয়ে শেষ হয়েছে গলিটা। দেয়ালের কোনো থেকে বের হওয়া অশত্থের ঝোপে ডেকে ওঠে একটি কাকের ছানা। গাছের ঠিক বাম দিকে একটা দরজা, না দরজা নয়, ভাঙা একটা অন্ধকার গহ্বর। সেই গহ্বরের গুহামুখ থেকে অকস্মাৎ একটা মেয়ে, না, ঠিক মেয়েও নয়, ভয় পাওয়া উদ্ভ্রান্ত একটা মেয়েলী শরীর হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়ে আসে। প্রায় উলঙ্গ, আতঙ্কগ্রস্থ শুকনো দুটো চোখ। সামনে আমাদের দেখেই খোলা বুকে বাম হাতের কাপড়গুলো চেপে ধরে এবং মুহূর্তেই আমাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় কিন্তু পারে না। আমি জায়গা দিতে ভুলে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। মেয়েটি টলতে টলতে এগিয়ে আসতেই নিজেকে আমি সেই সব দুর্গন্ধের ওপর অর্ধেক শায়িত অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। মেয়েটিও ভারসাম্য হারিয়ে আমার পায়ের কাছে। বুক ও পেটের মধ্যে কেমন এক আলোড়ন জেগে ওঠে, সবকিছু মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায় আমার। তবু হল না, কী আশ্চর্য! কিন্তু মেয়েটি ততোক্ষণে ওগরাতে শুরু করেছে।
সামনের সেই দরজার, ঠিক দরজা নয়, নারকীয় গহ্বরের সামনে তখন তিনটি তরুণের ছায়া। একজন প্যান্টের বোতাম লাগাচ্ছে, খালি গা। দু’হাত মাথায় তুলে চুল ঝেড়ে নিজেকে গুছিয়ে নেয় একজন। আর অন্যটি লাইটারের মৃদু শিখায় ধরিয়ে নেয় একটি সিগারেট। এক এক করে ওরা আবার গহ্বরের ছায়ায় মিলিয়ে যায়।
আমার চেহারা দেখে বোধ করি করুণা হল মাসুদের। একটা সিগারেট দিল হাত বাড়িয়ে।
পেছনে মেয়েটি তখনো হাঁপাতে হাঁপাতে বাম হাত দিয়ে শ্যাওলা পড়া দেয়াল ধরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। ভিজে পেটিকোটের ওপর তার নগ্ন দেহ, ঈষৎ কম্পিত এবং মাথাটা সামনের দিকে বেঘোর নোয়ান। এলোমেলো ঝুলে থাকা চুলগুলো তার খোলা বুক আড়াল করেছে। শীত ও সমস্ত শারীরিক যন্ত্রণা তার নগ্নতার ভরকে বিস্মৃত করেছে। সঙ্গমবন্দী কুকুর দুটোর চোখ আটকে আছে মেয়েটির দিকে!
সামনে থেকে মাসুদ রুবেল প্রায় একই সঙ্গে আমাকে ডাকে। হাঁটুর কাছে প্যান্টটা ছিঁড়ে গেছে…
সিগারেট ধরিয়ে আমি ওদের পিছু নিই। ওরা ফিসফিস করতে করতে এগিয়ে যায়। হাসি ও কথোপকথনের চাপা শব্দ অন্ধকার ও দু’পাশের দেয়ালে বাধা পেয়ে অন্য রকম গাম্ভীর্য আনে। পেছনে তাকালে অন্ধকারে ছায়ার মতো লাগে মেয়েটিকে। বামদিকের স্তন হাতের চাপে ওপরের দিকে টেনে কী যেন খুঁটিয়ে দেখছে। কেউ খামচে নিয়েছে, আঁচড়েছে কিংবা দাঁত বসিয়েছে। তার ক্ষত? কে জানে। এই স্তব্ধ অন্ধকারের পতিত গলিতে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। পেছনে ফেরা আমার দৃষ্টি ও কৌতূহল লক্ষ করে রুবেল বলল,
ও কিছু নয়। রমনার পাখি। বেশি গিলে ফেলছে, এই আর কি…
গলির শেষ মাথায় সেই ভাঙাচোরা বাড়িটার কাছে পৌঁছালাম। বাড়ি নয়, যেন প্রতœতত্তে¡র কঙ্কাল, দেহ-জোড়া মরা অতীত। কবে খসেছে পলেস্তরা চুন-সুড়কি, বোঝা যায় না। পায়ের শব্দে পায়ের তলা দিয়েই ছুটোছুটি করছে সচকিত ইঁদুর, আরশোলা। আর ফাঁক-ফোকরে শেকড় চারিয়ে বেড়ে উঠেছে অশত্থের ডালপালা, বুনো জঙ্গল।
গহ্বরের মুখে- যেদিক থেকে মেয়েটি হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়ে এসেছিল আর তিনটে তরুণ বের হয়ে আবার ঢুকে পড়েছিল- সেখানে পৌঁছালে ওরা আমার হাত ধরল। এক অজানা আশঙ্কা, শিহরণ আর কৌতূহলের মিশ্র অনুভূতি নিয়ে ওদের দিকে তাকালে মাসুদ বলল, ‘ভয় পাস নে, যে নরক থেকে ছুটি পেয়ে আমি চলে এসেছি, তারই দু’একটা চালচিত্র তোকে দেখাব। যদিও সাক্ষী হিসেবে তুই রয়ে যাবি, কিন্তু এখন আমার ক্ষতি করার ক্ষমতা জাগতিক মানুষের আয়ত্তের বাইরে…
হ্যাঁ, এ কথা ঠিকই। তবে আমার ওপর তুই আস্থা রাখতে পারিস। কেননা এখন আমি একটি স্বপ্ন দেখছি। আর স্বপ্ন কেউ বিশ্বাস করে না। -উত্তেজিতভাবে বলে উঠি আমি, যেন এতোক্ষণে একটা কিছু বলার মতো প্রসঙ্গ খুঁজে পেয়েছি। -‘আজকের সংবাদপত্রে তোর ছবি উঠেছে। তোর ডান চোয়ালে ছুরির দাগ ছিল। অবশ্য তোর ছবিটা খুব স্পষ্ট আসেনি’
খবরটা পড়ে সবাই খুব খুশি- তাই না? সবাইকে বেশ স্বস্তি দিয়েছে? মাসুদের এই প্রশ্নে আমি বিব্রত বোধ করি। একটা সময় যখন সম্পূর্ণভাবে রৌদ্রের হাতছানিকে অবহেলা করে, মানুষ যখন বিশ্বাস হারিয়ে নিজেদেরকে পশুর স্তরে নামিয়ে আনে, এবং পেশীর ক্ষমতার কাছে যে যুগ তার সমস্ত আত্মসম্মানবোধকে অবলীলায় বিকিয়ে দেয় তখন একটি তরুণের ক্ষোভ কিংবা মৃত্যুতে কতটুকু খুশি হয়ে ওঠা যায়- আমি বুঝতে পারি না। তবু মনে হয় যারা ওদের মৃত্যু কামনা করে তাদেরই হৃদয়হীন নিষ্ঠুর জীবন-যাপনের বিকৃতি, অর্থলিপ্সা, নারী আসক্তি ক্ষমতার স্বপ্ন যেন আরো বেশি প্রবল; আমাদের নজরে পড়ে না কেবল এই কারণে যে এরা যেসব গোষ্ঠীতে বিচরু করে তাদের পরিধি যেমন বিরাট, তাদের ক্ষমতা তেমনি অসীম। ওর মৃত্যু, মৃত্যুর আগে ওর সন্ত্রাস জাগানো কাজ-কারবার কিংবা তারও আগে যখন সে কলেজে আমাদের গ্রুপের সেরা ছাত্র এবং বন্ধু হিসেবে সে যে আমার ঘনিষ্ঠতম ছিল সে সব কথা মনে পড়ল। ওর মৃত্যু অথবা মৃত্যুর কার্যকরণের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ না থাকলেও এই মুহূর্তে মাসুদের জন্য আমার কষ্ট হয়। একটি মৃত বন্ধুর প্রশ্নের উত্তরে তবু আমি জাগতিক ধূর্ততার আশ্রয় নিই- দেয়ালের আড়ালে থেকে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করি। কেন জানি আমার মনে হয় মৃতদের কোনো অভিযোগ থাকে না। আমি ওকে বলি,
ঠিক খুশি নয়, তবে মোটামুটি সবাই এরকম চিন্তা করছে যে এই সব মৃত্যু আর মৃত্যুর কারণের মধ্যে অনেক ভুল রয়ে যাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে আমাদের ক্ষতি আরো গভীর হচ্ছে…
ক্ষতি?- মাসুদ একেবারে শুষ্ক স্বরে হেসে ওঠে। আমি ভয় পেয়ে যাই। খুব স্পষ্টভাবে ও বলে ওঠে, ‘আচ্ছা, তোর কি মনে হয় না, ক্ষতি বলতে তুই যা বোঝাচ্ছিস, আর দেশটা যেভাবে চলছে, দুটোই একটা অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ার ফল? আমার লাশটা কমলাপুরের ডোবায় পড়েছিল, সমগ্র দেশটাই কি কমলাপুরের ডোবায় কিংবা ম্যানহোলে মুখ থুবড়ে পড়ে নেই? মাতৃভূমিভক্ত বাঙালি কি আজ মা-কে উলঙ্গ করে বলাৎকার করছে না? আর এই পরিুতিগুলো সবাই তো মেনেও নিচ্ছে, শেষ পর্যন্ত নিচ্ছে তো?’
কিছু শোনার আশায় ও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। আমার সময়, আমার নিজস্ব মানুষ সম্পর্কে আমার সংশয় আজকের নয়। ভাবলে আমারও রক্তে আগুন জ্বলে, ইচ্ছা হয়- ঘৃণা করি, সবকিছু উচ্ছন্নে দিই! পিশাচের মতো হত্যা করি কয়েক লক্ষ নষ্ট কুকুর, এক রাত্রে। আবার মনে হয় হত্যা কোনো সমাধান নয়। কিন্তু এসব ওকে বলা যায় না। মৃত একটি বন্ধুকে উত্তেজিত করতে কষ্ট হয় আমার। ওকে তাই বলি, ‘অস্বাভাবিক যে কোনো মৃত্যুই অপূরুীয় ক্ষতি, মাসুদ। সবাই না হলেও কেউ কেউ তা স্বীকার করে’
কিন্তু আমার এ মন্তব্য খুব একটা প্রভাবিত করে না মাসুদকে। বরং মুখে কেমন একটা মায়াবী ভাব জেগে ওঠে ওর। একেবারে নিরাবেগ কণ্ঠে আমাকে বলে,
ভেতরের ঘরটা নিচু, বুঝলি। চার ধাপ সিঁড়ি ভেঙে নেমে তারপর এগুতে হবে। এখানে অন্ধকারটা একটু বেশি গাঢ়, সাবধানে পা ফেলবি
সিঁড়িতে পা দিয়ে ভেতরে প্রবেশের মুহূর্তে মেয়েটার কথা মনে পড়ে। সত্যিই সাবধান হয়ে যাই। একটা মৃত মানুষের সঙ্গ নিতে গেলে বাস্তবতার চাইতে যতোটুকু সাহস ও শক্তির প্রয়োজন, ওদের সঙ্গে আসার সময় সেটুকু মানসিক প্রস্তুতি নিতে ভুলিনি বলে ভালোই লাগল। তবু শরীরটা ছমছম করে ওঠে। অন্ধকারে ওদের একজনের হাতে আমার ডান হাত জমা দিয়ে তার ওপর শরীরের ভার অর্পণ করে গলিটার দিকে এক নজর তাকালাম। মেয়েটা নেই। শুধু কুকুর দুটো সমরেখায় দুদিকে মুখ করে স্থিরচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে আছে তখনো!
সিঁড়িতে পা দেবার আগে আমার চোখ আর চশমার দায় আন্দাজ, অনুভূতি এবং ওদের নির্দেশের হাতে ছেড়ে দিলাম। ওরা আমার অনভ্যস্ততা উপভোগ করছিল, যদিও ওদের মুখ চোখ শরীর আমি স্পর্শ ছাড়া অনুভব করার ভিন্ন কোনো উপায় উদ্ভাবন করতে পারছিলাম না।
মেঝেতে পা দিতেই ডান পা পিছলে সাঁ…করে কোন দিকে চলে গেলে আমি দ্বিতীয়বার ভাঙা ইটের আঘাত পেলাম হাঁটুতে। এতে করে একজনের মুখ থেকে অন্ধকার ফুঁড়ে চু চু …..ঠিক ইদুঁরের মতো সমবেদনার শব্দ ধ্বনিত হলো অথবা হয়তো কোনো ইঁদুর আমার পড়ে যাওয়া শরীরের চাপে পিষ্ট হয়ে ডেকে উঠল, আমি বুঝতে পারলাম না। তবে মাসুদের অত্যন্ত মানবিক উচ্চারু আমি টের পেলাম
খুব লাগল বুঝি!
পরপর দুবার এই আঘাত ও এই অনভ্যস্ত পরিবেশে নিজের অনিবার্য অসহায়তার মাঝেও অকস্মাৎ আমার মনে এই নিশাচর গৃহপালিত প্রাণীগুলোর জন্যে মায়া উপচে উঠল। আমার ধবধবে বিছানার চাদর, বালিশ, লেপ, টেবিলের ওপর গ্লাসে ঢাকা পানি আর বই, আমার স্মৃতি চোখে একবার দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। ভাবলাম, কাদের সঙ্গে এ আমি কোথায় এলাম। মৃত্যুর আগে মাসুদের সঙ্গে আমার বহুদিন যোগাযোগ ছিল না, মৃত্যুর পর সে কেন আমাকে বেছে নিল এইসব উদ্ভট (অথচ কতো অনিবার্য!) জগৎ দেখাবে বলে? হয়তো হতে পারে ওর স্বাভাবিক ছাত্রজীবনে আমিই ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম, যা ও ভোলেনি। যাই হোক, এসেই যখন পড়েছি, এখন আর ফেরা যাবে না। যার হাত ধরে আমি এই গহ্বরের সিঁড়িতে প্রবেশ করেছিলাম, পড়ে যাওয়ার পরও সে হাত আমি ছাড়িনি। সেই হাতে ভর দিয়ে আমি টাল সামলে উঠে দাঁড়াই।
আরেকটু সাবধান হতে হবে। মেঝেতে ইট নেই তো, আর ড্রেনের পানি উপচে এই খাদগুলোতে এসে জমে। খুব পিচ্ছিল।- মাসুদ কথা থামিয়ে রুবেলকে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করে। রুবেল এগিয়ে গেলেও আমার ধরা হাতটি বিচ্ছিন্ন না হওয়াতে বুঝলাম আমি মাসুদের হাত ধরেই চলছি। না, চলছি না ঠিক, ওদের সঙ্গে চালিত হচ্ছি। পা টিপে টিপে। মাসুদ এই অন্ধকারের ঘ্রাণ নিতে আমাকে সহায়তা করে- কবেকার পোড়ো বাড়ি। এর হাত পা মাথা কোমর উচ্ছন্নে গেছে। যে কোনো জায়গা থেকে লাথি মেরে ইট বার করে নেয়া যায়। এরকম বাড়িতে গিছিস কখনো?
মনে করতে পারি না, দেখেছি কি? সোনারগাঁয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম, ওখানকার পানাম নগরের ধ্বংসাবশেষের কথা মনে পড়ে। কিন্তু আমার এখন সব থেকে জরুরি একটু আলো। ওকে তাই বলি
এত অন্ধকার আমি কখনো দেখিনি
কেউ তো থাকে না, আলো আসবে কোত্থেকে
কেন, তোরা?
আমরা? আমি তো চলেই গেছি। ওরাও যে ক’জন আছে এখানে আর আসে না। খাকি কর্তাদের ট্যাক্স না দিয়েই আমরা কাজ চালাতাম কি-না, ব্যাটারা টের পেয়ে গেছে। এখন ইঁদুর, আরশোলা চামচিকে নিশ্চিন্তে চলাফেরা করে। দু’একটা কুকুর বিড়ালও থাকতে পারে হয়তো…
আর ওরা?
কারা?
ওই যে তিনজনকে দেখলাম?
ওহ! ওই তিনজনের একজন এখন জেলে, একজন? গোপনে পালিয়েছে- জার্মান না কোথায় যেন। আর অন্যটা আমার আগেই অন্য এক গ্রুপের গুলিতে শেষ- যেন একটা জমি কিংবা সড়কের বর্ণনা দিল ও
একটা চামচিকে হঠাৎ ঝপঝপ শব্দে গন্ধ ছড়িয়ে মাথার উপর এক নাগাড়ে চক্কর দিতে শুরু করে। গহ্বরে প্রবেশ করার পর সেই কখন থেকেই হেঁটে যাচ্ছি কিন্তু অন্ধকার, অচেনা দু’একটা শব্দ আর মাসুদের ভরাট গলা ছাড়া দেখতে পাচ্ছিলাম না কিছুই।
এবার আমরা আবার সিঁড়ি বেয়ে পাঁচ ধাপ ওপরে উঠব। ভয় পাবার কিছু নেই। এর ধাপগুলো আগেরটার চেয়ে ভাঙা হলেও বেশ শুকনো। পা টিপে সাবধানে উঠলে পড়ার আশঙ্কা কম।- মাসুদ আমাকে আশ্বাস দেয়।
আমি ওর হাত ছেড়ে নিচু হয়ে সিঁড়িটাকে স্পর্শ করতে চাই। ওরা উপরে উঠে আমার জন্যে অপেক্ষা করে।
অন্ধের মতো সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিয়ে দ্বিতীয় ধাপ আঁকড়ে ধরি, দ্বিতীয় ধাপে পা দিয়ে তৃতীয় ধাপ… চতুর্থ ধাপে উঠলে মাসুদ আমার ডান হাত ধরে টেনে তোলে।
উপরে উঠে আমি দীর্ঘ একটি শ্বাস টেনে ক্লান্তি সরানোর চেষ্টা করি। সামনে প্রায় দু-ঘর দূরত্ব থেকে ভাঙা জানালার খোপ পেরিয়ে আসা কাঁপা আলোর ছায়া চোখে পড়ে। স্রেফ নিরুজ্জ্বল আলোর ছায়া।
সামনে মাত্র দুটো ঘর, আমি ভাবলাম, আর অল্প হলেও আলো আছে। অন্তত দেখে হাঁটা যাবে। কেননা ওরা ঠিক একটি চারপেয়ে জন্তুকে দুপায়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাবার মতো আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল। প্রথম ঘরটা অতিক্রম করার সময় হঠাৎ ওপরের দিকে চোখ গেল। ভাঙা ছাদের এক ফুটো দিয়ে এক টুকরো ত্রিকোণ আকাশ! তার মধ্যে দু’একটা তারা। বাইরে বোধ হয় এখন ভালো কুয়াশা। বাম পাশের দেয়ালে চারকোণা ছোটো একটা জানালা, পাল্লা নেই। জং-পড়া দুটো শিক কোমর বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দু‘শিকের মাঝখানে মাকড়সার জালে আটকে ঝুলে আছে মরা একটা টিকটিকি। দ্বিতীয় ঘরটায় আরেকটু আলো। মেঝেতে ছড়ানো বোতল, বিয়ারের টিন, ফিল্টার, ছাই, ছেঁড়া নেকড়া। বাতাসে দম আটকে আসা ঝাঁঝালো গন্ধ। এক কোণে সেই তিন তরুণের একজন দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করছে।
ভূ-গর্ভস্থ দুর্গের প্রকোষ্ঠ যেন- একটা মাত্র মোমবাতির শিখায় স্যাঁতসেতে ঘরটা কেমন কুঁকড়ে-সুকড়ে নোংরা দাঁত বের করে ঘাপটি মেরে আছে।
দরজার বামদিকে একটা টেবিলে পা ঝুলিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে পিস্তল পরিষ্কার করছে একজন। মাসুদ বলল, ও কাদের, আমার আগেই গুলি খেয়ে যে স্বস্তি দিয়েছে বলছিলাম। কাদের আমাকে দেখেও নিস্পৃহের মতো নিজের কাজে ব্যস্ত রইল। মোমবাতিটা ওই টেবিলের এক কোণে আটকানো; দরজার সামনে ডানদিকের মেঝেয় একটা মাদুর পাতা। ওখান রুবেল গিয়ে বসেছে। তার পাশে পায়জামা পাঞ্জাবি পরা মোটাসোটা টেকো মাথার এক ভদ্রলোক। রুবেল তাকে বড়ো একটা স্কচ হুইস্কির বোতল থেকে গ্লাসে ঢেলে দিচ্ছিল। মদের সঙ্গে সুগন্ধী জর্দা দেয়া পান চিবিয়ে যাচ্ছে হরদম। ঘরের মধ্যেখানে একটা চেয়ারের কঙ্কাল। তৈরির সময় হয়তো হাতল ছিল, এখন সেখানে ভাঙা ছুঁচালো দুটো কাঠ দু‘পাশে উঁচু হয়ে আছে। মাসুদের ডান দিকে একটা জীর্ণ চাদর ঢেকে পার্টিশন করা হয়েছে ঘরটা। চাদরের ওপাশ থেকে শ্বাস-প্রশ্বাসের ভারি আওয়াজ গালাগালি ধস্তাধস্তি চৌকির ক্যাঁচকাঁচ শব্দ এসে কানে বাজে। অনবিচ্ছিন্ন এই সব বাস্তবতা এভাবেই আমার সম্মুখে দৃশ্যমান হয় এবং অপেক্ষায় থাকে আরো কিছু…
মাসুদ আমার বন্ধু যদি-বা, ও এখন পাতাল জগতের বাসিন্দা। ওর এই অস্বাভাবিক অবস্থার জন্য আমি বিরক্তি প্রকাশ করতে পারি না- কি জানি কী মনে করে বসে। অথচ আমার এ কৌতূহল এখনো মিটল না যে মৃত্যুর অনালোকিত পরপার থেকে উঠে এসে কেন মাসুদ আমাকে ডেকে নিয়ে আসল এখানে, আর কেনই-বা তার পূর্বকৃত একটি রাতের এই পাপ ও অনাচারের সাক্ষী হিসেবে আমাকে বেছে নিল!
বোধ করি আমার এ কৌতূহল বুঝতে পেরে মাসুদ কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
বেঁচে থাকতে আমাদের অনেক বিচিত্র রাত কেটেছে। আজ যে রাতের অন্ধকূপে তোকে নিয়ে এসেছি, আমাদের কতগুলো ভুল সিদ্ধান্ত ছিল এই রাতটায়। এক এক করে সব দেখতে পাবি আর প্রয়োজনের সময় বাকিটুকু আমি বলে দেব। তাছাড়া ভাবলাম আমাদের সম্পর্কে অনেকেরই একটি অজানা রহস্যময় ধারুা রয়েছে। অনেকেই আমাদের ব্যাপারে কিছু কাল্পনিক চরিত্র তৈরি করে ইচ্ছেমতো ভয় আর শিহরণ অনুভব করে তৃপ্তি পায়। তার থেকে বরং সরাসরি এই দৃশ্য কোনো জীবিতের সঙ্গে থাকলে কেউ হয়তো উপকার পেতে পারে- তাই না?
কথা শেষ করে কানের কাছ থেকে মাসুদ মুখ সরালে দেখলাম পাশের ঘরে পেচ্ছাব করা ছেলেটি মাদুরে এসে বসল। ও জাহিদ, মাসুদ বলল, এখন জেলে। খুব অল্প সময়ে চারটে খুন করে ও বসের খুব প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিল। প্রতিপক্ষের স্কুলগামী এক মেয়েকে জিম্মি করতে গিয়ে হাতে-নাতে ধরা পড়ে গেল। কিছুই করা গেল না। হত্যা ধর্ষণের দায়ে ফাঁসির হুকুম হয়েছে।
আমি জাহিদের দিকে তাকাই, এমন ভাবশূন্য নিরক্ত মুখ আমি আগে দেখিনি। যদিও বুঝতে অসুবিধা হয় না মাসুদ ছাড়া আমার উপস্থিতিকে কেউ তেমন তোয়াক্কা করছে। যে যার নিজের খেয়াল আর ইচ্ছায় ডুবে আছে যেন।
মাসুদ মাদুরে গিয়ে আমাকে তার বামপাশে, পেছনে বসায়। ওর মুখোমুখি এখন রুবেল, জাহিদ আর টেকো মাথার ভদ্রলোকটি। এরকম ভারি, থলথলে শরীর নিয়ে মাসুদের মতো কিছু করা ভদ্রলোকটির পক্ষে সম্ভব নয়- বুঝতে অসুবিধা হয় না। ওর সম্পর্কে এখনো কিছু বলেনি মাসুদ।
‘কটা বাজে?’ মাসুদের হাতে ঘড়ি থাকার পরও জিজ্ঞেস করে। আর এই প্রথম ওর পরিবর্তিত গলার নির্দয় স্বর শুনে আমি চমকে উঠি। মাদুরের পাশে বালি, সিমেন্ট ওঠা এবড়ো খেবড়ো মেঝেতে পানের পিক ফেলে, বাম হাতের সোনালি ডায়াল থেকে ভদ্রলোকটি জানায়- পৌনে দুটো। কেমন ফ্যাসফেসে চিকন গলা লোকটার!
কাদের পিস্তলটা জ্যাকেটের ভেতর পকেটে গুঁজে টেবিল থেকে নেমে আসে। পর্দা সরিয়ে চৌকির তলা থেকে পাঁচ ছ’টা বোতল বের করে আনে। গোল আড্ডার মধ্যখানে কানা বাঁকা টিনের অবয়বলুপ্ত গ্লাসগুলোয় কাদের বোতল খুলে সার্ভ করে। পর্দার ওপারে চৌকির ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দের সঙ্গে উদ্ভট মেয়েলী শব্দ আসে। অশ্লীল মন্তব্য সমেত একচোট হাসির হল্লা এই রাত্রির স্তব্ধতাকে আরো প্রকট করে তোলে। মাসুদ ছাড়া সবাইকে ব্যাপারটা উপভোগ করতে দেখি। অথচ অবয়বে কোনো ভাবান্তর না এনে মাসুদ রুবেলকে কতো সহজ স্বরে বলে, সোহেলের হয়ে গেছে- ত্ইু ঢুকবি না-কি?
সুযোগ পেয়ে ঠোঁটের কোণে পানের পিক মুছতে মুছতে ভদ্রলোকটি রুবেলকে কনুই-এর ধাক্কা মারে, যাও হে, গায় গতরে জিনিসটা মন্দ নয় কিন্তু- হাসতে গেলে তার ঠোঁটের কোণা বেয়ে পানের পিক সিল্কের শাদা পাঞ্জাবিতে গড়িয়ে পড়ে।
রুবেল ওর দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকায়। ভর দুপুরে জাবর কাটা গরুর চোখের কথা মনে পড়ে আমার। বেশ অন্যমনস্ক লাগে রুবেলকে। বিরক্ত কোরো না- বলে ও গ্লাসটা শিথিল ভঙ্গিতে শেষ করে আবার ভরে নেয়।
ওপার থেকে সোহেল বেরিয়ে এসে ওদের সঙ্গে যোগ দেয়। কাদের সোহেলকে লক্ষ করে রসিকতা ছোড়ে, ক-বার দম দিলিরে?
সোহেল ভ্রু উঁচিয়ে পশ্চিমী ছবির মতো কাঁধ ঝাঁকায়।
মাসুদের উপকারের কাছাকাছি এসে আমার অসহনীয়তা এবার ছটফট করে। একটা সিগারেটের জন্য আমি অস্থির হয়ে উঠি। চাইতে সংকোচ হয়। ভাগ্যিস তখনই মাসুদ তার প্যান্টের পকেট থেকে বেনসনের প্যাকেট বের করে নিজে ধরিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দেয়। এদের সবার সামনে আমার নিষ্ক্রিয় উপস্থিতি বিপাকে ফেলে। তবু এই অনিয়মের জগতে একটা সিগারেট ধরিয়ে বুক ভরে ধোঁয়া না টেনে আমি পারি না। হুইস্কির বোতলের দিকে ইশারা করে মাসুদ আমাকে জিজ্ঞেস করে, চলবে?
আমার স্নায়ুগুলো মুহূর্তেই আমাকে সচেতন করে দেয়। চলে, কিন্তু এই দুর্লভ মুহুর্তে চালালে, সমগ্র রাতটাই বৃথা অপচিত হবে হয়তো। আমি তাই অনায়াসে নিজেকে সংবরু করে মাথা নাড়ি, একটা করে সিগারেট দিয়ে যাবি- তাতেই চলবে।
কোনো পূর্ব পরিকল্পনা আছে কিনা বুঝতে পারি না। মোমবাতির আবছা ক্ষীণ আলোয় নিঃশব্দে সবাই পান করতে থাকে। টেকো ভদ্রলোকটি কিছু বলার জন্যে তৎপর হয়ে উঠলে মাসুদ তাকে ইশারায় থামিয়ে দেয়। চোখ মুখ চেহারার প্রতিটি অনুতে সবার সূক্ষ পরিবর্তন আসে। বসার শুরুতে প্রতিটি দেহে যে সচেতন দৃঢ়তা দেখেছিলাম, এখন সেখানে এক ধরনের শঙ্কা ও সন্দেহের গোপনীয় দুর্বোধ্যতা। সামান্য আলো ঘরের ব্যাপক অন্ধকারকে প্রতিহত করতে না পেরে বরং প্রতিটি শরীরকে, শরীরের ছায়াকে বহুগুণ প্রলম্বিত করে তোলে। এবড়োখেবড়ো মেঝেয় দেয়ালে সেই ছায়া বিভিন্ন আকৃতি নিয়ে ভৌতিক নৃত্যে মাতে। মনে হয়, দীর্ঘ সময় নিয়ে এই মদ পান ভিন্ন কিছুর প্রস্তুতি মাত্র! যে কোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে ভয়ঙ্কর কিছু!
আশ্চর্য হই না, যখন দেখি সেই অন্যমনস্ক রুবেল কোনো ফাঁকে পর্দার ভেতরে ঢুকে চৌকিতে আগের মতোই মৈথুনে মত্ত হয়! এমন অদ্ভুত যৌনতা আমার কল্পনায় ছিল না।
মাসুদের গাম্ভীর্য আমাকে আরেকবার চমকে দিয়ে যায়। সিগরেটের প্যাকেটটা আমার হাতে তুলে দেয়, ধরা। প্যাকেট ফেরত দিতে গেলে বাধা দেয়, রাখ তোর কাছে। এরপর মাসুদ সবাইকে চমকে দিয়ে কাপড়ের পর্দাটা এক হ্যাঁচকায় নামিয়ে আনে। আকস্মিক এই ব্যবহারের তাৎপর্য না বুঝলেও রুবেল ও তার নিচের মেয়েটির সঙ্গমরত শরীরকে বেশ বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয়। রুবেলের ভাঙাচোরা ধ্বস্ত চেহারায় কী যেন, হয়তো যন্ত্রণা কিংবা ক্রোধ, কিছু একটা কাজ করে হয়তো।
যা, কল্কেটা ভালো করে সাজিয়ে আন, তাড়াতাড়ি- মাসুদ নিস্পৃহের মতো মদের গ্লাসটা আবার তুলে নেয়।
রুবেল নেমে আসে। দু’হাত প্রসারিত করে মেয়েটি লজ্জা ঢাকতে চায়। কিন্তু সোহেল মেয়েটির স্তনে রাখা হাতটি ধরে মেঝেয় নামিয়ে আনে। মাসুদ বাধা দেয় না। নগ্ন মেয়েটিকে ও ধাক্কা দিয়ে পাঠিয়ে দেয় টেবিলের দিকে। অবর্ণনীয় (!) ইশারায় ওকে নাচতে বলে।
মেয়েটির সম্পূর্ণ উলঙ্গ শরীরে সকলের সশস্ত্র চোখ আছড়ে পড়ে। ধাতস্থ হতে সময় নেয় মেয়েটা। রুবেল ঘর থেকে অন্ধকারে কোথায় বেরিয়ে যায় কল্কে সাজাতে। টেকো ভদ্রলোকটি চৌকিতে পিঠ রেখে মেয়েটির দিকে পা ছড়িয়ে অর্ধেক শুয়ে পড়ে। ছিপছিপে লম্বা, শ্যামলা সুতীক্ষ্ণ শরীর, মোমবাতির আলোয় ওকে দেখে ভেজা মাটির রঙ মনে পড়ে। সামনে, পাঁজরের ঈষৎ উদ্ধত হাড়ের জায়গা দুটো চিকচিক করে মেয়েটির। শনের মতো শুষ্ক অল্প চুল ছড়িয়ে আছে, বুকে পিঠে। ড্যাবডাবে চোখ দুটোয় বাধ্যতামূলক আনুগত্য ও কষ্টের ছাপ। নুয়ে পড়া চড়ুই শিশুর মতো মলিন দুটো স্তন, যেন মৃত, হেলে পড়ে আছে দু’দিকে, অনেকগুলো আঁচড়ের দাগ। সোহেলের খিস্তির মতো আলগা করে দেখানোটা যেন এ নাচের সর্বস্বতা। কয়েক মুহূর্ত দেখে আমার মনে হল, শরীরে কিঞ্চিৎ আবরু সমেত একই ধরনের নাচ আমি বাংলা কিংবা হিন্দি ছবিতে দেখেছি। সোহেল গ্লাসে মদ ঢেলে মেয়েটির অনিচ্ছা সত্তে¡ও একবার গিলিয়ে আসে। ‘চালিয়ে যা, থামবি না, বুঝলি- নিজের জায়গায় ফিরে আসে সোহেল। মেয়েটি আচ্ছন্নের মতো হাত পা বুক ছুঁড়ে যায়। মোমবাতির কম্পিত শিখায় ওর দীঘল শরীরের গাঢ় ছায়া কখনো মেঝেয়, কখনো দেয়াল এবং সিলিঙে অপ্রাকৃত দৃশ্য তৈরি করে। হঠাৎ আমার খেয়াল হয়, আজ রাত্রে আমার সামনে এই দৃশ্যটিই শেষ নয়, আরো কতো এরকম অজস্র দৃশ্য এই মুহূর্তে তৈরি হয়ে রাত্রির গাঢ় অন্ধকারকে বীভৎস করে তুলছে, আমি দেখি না- এই যা!
অসুবিধা হচ্ছে কিনা জেনে নিয়ে মাসুদ আমাকে চৌকিতে হাত-পা ছড়িয়ে বসতে বলে।
ওদের গোল চত্বর আস্তে আস্তে অধিকতর সুষম এবং ছোট হয়ে আসে। মাসুদ তর্জনীর সঙ্কেতে ভদ্রলোকটির মনোযোগ আকর্ষণ করে, এতোক্ষণ সে-ও মদ ও পানের সঙ্গে মেয়েটির উলঙ্গ শরীর আকণ্ঠ পান করছিল।
রুবেল তোমার ওখানে কবে গিয়েছিল?- সুড়ঙ বেয়ে আসা শব্দের মতো মাসুদের গলা।
গেলো সপ্তায় … শুক্কুরবারে
মাসুদ হিসেব করে- অর্থাৎ ঠিক ছ’দিন আগে, তাইতো। ব্যাপারটা সরাসরি আমাকে না বলে ওকে ধরলে কেন
মাসুদের এ অভিযোগে ভদ্রলোক কেমন হকচকিয়ে উঠে বসে। মদ ও সম্মুখবর্তী মেয়েমানুষের ঘোর যথাসম্ভব কাটিয়ে উঠে বলতে থাকে, না মাসুদ ভাই, এটা ঠিক না। দ্রুত কথা বলতে গেলে শব্দগুলো খানিকটা জড়িয়ে যায়। মাসুদ রেগে উঠলে সেটা তার জন্য ক্ষতিকর, টের পাওয়া যায় ওর কথা বলার অনুষঙ্গে, ‘আমি ওর কাছে গেছি, এটা ভুল ধারনা। আমি যাবো কেন আপনাকে বাদ দিয়ে? প্রশ্নই ওঠে না। আসলে আমার খুব তাড়া ছিল। লোকটার সঙ্গে আমার প্রায় দশ লাখের একটা ডিল হয়েছে। ওই দিনই। এসব কাজে ডকুমেন্ট থাকে না, তাতো জানেনই। কিন্তু হুট করে শুনলাম সব টাকা নিয়ে লোকটা না-কি ওই রাতেই একেবারে কেটে পড়েছে, কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে। ওদিকে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কর্মচারীরা ভয়ানক শয়তানি শুরু করেছে, পুলিশের সঙ্গে বোঝাপড়া করতেই হয়রান। বুঝতেই পারছেন এ খবরটা শুনে আমার প্রেশার গেল বেড়ে। ছটফট করতে করতে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবো ভাবছি, এমন সময় রুবেল গিয়ে হাজির। পকেট খালি বলে হাজার পাঁচেক টাকা চাইল। তখন বিকেল প্রায় চারটে। হাতে সময় নেই। ভাবলাম, রুবেল তো আপনারই লোক। ওকে ভার দেয়া মানে আপনাকেই দেয়া। রুবেল নিশ্চই আপনাদের ছেড়ে কিছু করবে না। রুবেলও আপনার রেফারেন্স দিয়ে বলল, সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, কিন্তু আমাদের দু’লাখ ছেড়ে দিতে হবে
টাকাটা কি তখনই দিয়েছিলে? মাসুদ জিজ্ঞেস করে
না, তখন অল্প কিছু দিয়েছিলাম। পুরো টাকাটা আমার হাতে তুলে দেবার পর বাকিটা ওকে দিয়েছিলাম
সে লোকটার কী করলো ও?
রুবেল ওকে আরিচা রোডের পাশে কোথায় গুঁজে রেখে এসেছিল
কাদের নিঃশব্দে তাকিয়েছিল ওদের দিকে। এবার খালি গ্লাসটা মুখ থেকে নামিয়ে সশব্দে মাসুদ রাখে। অর্ধেক শব্দ পেটে রেখে বাকি অর্ধেক উচ্চারণ করে ও, বে-ঈমান!
ওদিকে মেয়েটি হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে কখন শ্রান্ত হয়ে পড়েছিল, ভারসাম্য হারিয়ে টেবিলের ওপর পড়তে একজন স্বর টেনে হেঁকে ওঠে, লে বাবা, পড়েই গেলি, ওঠ ওঠ…
মেয়েটি ঠোঁট বিস্তৃত করে বিনীত হবার চেষ্টা করে। এতোক্ষণে ওর বুকে নখের চিহ্নগুলোর রক্ত জমে কালচে হয়ে উঠেছে। নাভির নিচে তাকালে আমার গা কেমন ঘিনঘিনিয়ে ওঠে। দাদের ঘা থেকে চামড়া ওঠা কয়েকটা শাদা শাদা দাগ, শ্যামলা শরীরে শ্বেতীর মতো ফুটে উঠেছে। চারপাশে ঘামাচির মতো ঘন ফুসকুড়ি নাকি শীতের কামড় আর ক্লান্তিও
হঠাৎ চোখ দুটো একবার সোহেলের দিকে ঘুরিয়ে অসহিষ্ণু কণ্ঠে ভদ্রলোকটি উচ্চারু করে- আপনাকে কিছুই বলেনি ও? অন্তত আপনাদের অংশটুকু তো দেয়া উচিত ছিল রুবেলের
মাসুদ কোনো কথা বলে না। ভয়ঙ্কর এক গাম্ভীর্য তৈরি করে ধোঁয়া ছাড়ে ও। তখন সিমেন্টের মেঝেতে একটা টিনের বাসুন পড়ার প্রলম্বিত শব্দ রাত্রির নির্জনতা ভেদ করে আমাদের কানে আসে। এই সময়ে, রাত যখন তার সমস্ত বাহু বাড়িয়ে পৃথিবীকে ভিন্ন একটি রূপের গহনে টেনে এনেছে, ঘুম আর জীবনের স্বাভাবিক হলাহল ছাড়া যে কোনো শব্দই এখন কতো অস্বাভাবিক, সন্দেহজনক আর রহস্যময়! রাত্রির নিজস্ব স্বরের প্রভাবে সবকিছুরই এতো রূপান্তর, না জাগলে কবে টের পেতাম!
সোহেল কম কথা বললেও বেশ উত্তেজিত মনে হয় ওকে। গলা টেনে কৃত্রিম ভঙ্গিতে ও অবলীলায় বলে ফেলে, শেয়ারটা আজকেই নেয়া যাক ওস্তাদ–ওর বেঈমানির মাশুল আজকেই দিয়ে দিই
টেকো ভদ্রলোক ঊরু চুলকাতে চুলকাতে ত্রণ্ডূর চোখে তাকায়, যেন সোহেলের সিদ্ধান্তটা খুব বেপরোয়াভাবে মাসুদ গ্রহণ করলে ও স্বস্তি পায়!
দরজার বাইরের পদশব্দে অকস্মাৎ সবাই চুপ মেরে গ্লাস ও মেয়েটির দিকে মনোযোগ দেয়। মেয়েটি তখনো যেন ঘুমের ঘোরে হাত-পা ছুঁড়ে চলে। রুবেল অন্ধকার থেকে দরজার এপারে পা রাখতেই চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে কোনো রকমে নিজকে সামলায়।
বিভ্রাস্ত ইদুঁরের চি চি স্বরে কাদেরের দুঃখ প্রকাশে আমি চমকে উঠি। মাসুদ কল্কেটা রুবেলের হাত থেকে নিয়ে লোকটাকে দেয়।
ভদ্রলোকটার দারুণ একেকটা টানে কল্কের মুখে হিসহিস আগুন ঠিকরে ওঠে। রুবেল ইতোমধ্যে ভারসাম্যহীন, হয়তো বানানোর সময় খুব করে টেনেছে। মাসুদ আমার কানে ফিসফিসিয়ে ওঠে: গাঁজা চরস আর আফিমের মিক্সচার দিয়ে কল্কেটা সাজানো হয়েছে
মেয়েটির হাত-পা ছোঁড়া আরো ঢিলে হয়ে আসে। টাকঅলা ভদ্রলোকটার হাত থেকে নেয়া কল্কেতে রুবেল পাঁচ-ছয় টান দিয়ে দাঁড়ায়। পিচ্ছিল শ্যাওলার ওপর দিয়ে হাঁটার মতো ও স্খলিত পায়ে মেয়েটার কাছে গিয়ে ওর সাড়াশব্দহীন মৃত স্তনে, ঠোঁটে, নাভিতে চুমু খেয়ে আসে। মেয়েটা কেমন যান্ত্রিক অভ্যাসে ওর পিঠে হাত রাখে। রুবেল আর টেকো ভদ্রলোকটিকে ছাড়া আর সবাইকে লক্ষ করি প্রায় খালি গ্লাস নিয়ে সবাই নড়াচড়া করছে। হরদম চালিয়ে যাচ্ছে ওরা দু’জন। সিগারেটের ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে আমার।
সোহেল একবার ভদ্রলোকটাকে জিজ্ঞেস করে, কেমন লাগছে, ওস্তাদ
লালচে ভারি মুখ বিকৃত হয়ে ওঠে লোকটার, ‘আল্লার কসম, সা…লা, রুবেল যা বানিয়েছে না, এক নম্বর
কল্কেটা শূন্যে তুলে ভালো করে পরখ শেষে ফের সবাইকে জানান দেয়, সে যা বলেছে তা একেবারে খাঁটি- এক নম্বর বানিয়েছে, মিথ্যা বললে মুখ খসে যাবে, স্লা… আল্লার কসম, রুবেল
আমি ঘড়ির দিকে তাকাই। তিনটে পঁচিশ। দেয়ালে টিকটিকি শিকার শেষ করে ভরাট পেটে স্থির দঁড়িয়ে আছে।
একটি রাতের এই অবাস্তব একঘেয়ে দৃশ্যের সূঁচ আমার চোখ ও স্নায়ুকে ক্লান্ত করে। অথচ কতো রাত ধরে, কতো দিন ধরে ওরা পড়ে আছে এসবের মধ্যে! এই দুঃস্বপ্নের শেষ দৃশ্যের পর মাসুদ আবার আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসবে তো! ধাঁধাঁর ভেতরে নির্বিকার দর্শকের ভূমিকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই আমার।
ইতোমধ্যে ওস্তাদ ভদ্রলোকটি আরেক বোতল শেষ করে চিৎপাত হয়ে নাক ডাকছে। বাকিটুকু বেঈমান রুবেলকে একাই শেষ করাতে উৎসাহ দিয়েছে ওরা, কৌশলে। এখন রুবেল মেয়েটির বুকে মাথা রেখে, ছড়ানো শূন্য বোতলগুলোর ওপর পা ফেলে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ আবোলতাবোল বকে সে-ও এখন ঠাণ্ডা। আর মেয়েটা রুবেলের মাথা বুকে নিয়ে ক্লান্ত শরীরে লুটিয়ে আছে। একটি যুবতী মেয়ে, এমন কাম-গন্ধ-শূন্য নিরেট হয়ে উঠতে পারে, এই অপ্রত্যাশিত রাত্রি ঠিক এভাবেই আমাকে অভিজ্ঞ না করলে হয়তো টের পেতাম না সারা জীবনেও।
মাসুদ সিগারেট ধরিয়ে মেয়েটাকে বিদায় করার জন্য সোহেলকে ইঙ্গিত দেয়।
আমাদের সামনেই মেয়েটি নির্বিকারে এক একটা কাপড় শরীরে জড়িয়ে কঞ্চির মতো দেহটি নিয়ে পৃথিবীর করুণতম প্রাণীর মতো মাসুদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
মাসুদ পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিলে মেয়েটি সে-ই অন্ধকার গুহা-মুখের ভেতর ক্রমশ বিলীন হয়।
এরপর মাসুদকে খুবই মমতাশূন্য পাশবিক ঠেকে। কাদেরকে টিটকারি মারে,
এক্সপ্রেসে ওর সিট রিজার্ভ কর, স্বর্গযাত্রা, পথ কম নয়। তাড়াতাড়ি রওয়ানা হোক!
একথার কোনো প্রত্যুত্তর হয় না। আমি মোমবাতির নিঃসঙ্গ কাঁপুনি লক্ষ করি। ওদের ইঙ্গিতসমূহের তাৎপর্য লক্ষ করে আমার অনৈচ্ছিক পেশী-কোষগুলোয় ভীতিবোধ জেগে ওঠে, ফলে মোমবাতির স্বাভাবিক কাঁপুনিকে আমার অশরীরী মনে হয় তখন।
জাহিদ চৌকির তলা থেকে মোটা একগাছি দড়ি বের করে। কাদের মাদুরের ওপর দাঁড়িয়ে হাত পা ছুঁড়ে আলস্য ঝাড়ে। আমার দিকে অকস্মাৎ হাত বাড়ালে হৃদপিণ্ডে বাজ পড়ে যেন। শুষ্ক অর্থহীন চোখে ওর দিকে তাকালে বড়ো অমানবিক লাগে ওর বাম চোখকে। কিন্তু মৃতেরা বোধহয় ভাবনাও টের পেয়ে যায়। আমার ভয়কে দীর্ঘস্থায়ী না করে ও বলে, ওটা পাথরের চোখ, একটা সিগারেট দাও।
আমি দ্রুত একটা সিগারেট দিয়ে ওকে আগুন অফার করি। আমার হাত কাঁপছিল। চমৎকার একটা ধন্যবাদ দিয়ে ও আমাকে আশ্বস্ত করে কোমরের খাপ থেকে বের করে ছুরি। ফলাটি ঢেউয়ের মতো বাঁকানো। শিখার সামান্য আলোও সেখানে ঝকমকিয়ে ওঠে। মাসুদ তখনি আমার ঊরুতে হাত রেখে বলে, কি-রে, সহ্য হবে তো!
কানের পর্দা ফাটিয়ে শব্দগুলো কোথায় যেন চলে যায়।
কি-রে!
চড় চড় করে কান দুটো যেন খুলে আসতে চায়। ওর দ্বিতীয় বারের ধাক্কায় আমি সম্বিত ফিরে চৈতন্য ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করি।
ভয় নেই, আমি তো আছি- ও আমাকে অভয় দেয়। হ্যাঁ, ও আমার অভয়দাতাই বটে। কলেজ পরীক্ষায় ও আমাকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে সিটে বসিয়ে দিয়েছিল, পরীক্ষা দিয়ে ফেল কর, তবু সান্তনা থাকবে। আর সামনে তো আমি আছিই- ওর দুর্দান্ত সহযোগিতায় পরে সাহস ফিরে পেয়ে ভালেই পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কয়েক মার্কের জন্য ও স্টার পায়নি। আমি কোনো রকম প্রথম বিভাগ। রেজাল্ট পেয়ে ও আমাকে বন্ধুসুলভ খিস্তিতে বলেছিল, সাহস রাখতে হয় বুঝলি…
পিঠ থেকে মাসুদ হাত সরিয়ে নেয়। মেয়েটাকে বের করে সোহেল ফিরে আসে। তিনজন এক সঙ্গে রুবেলের দিকে এগিয়ে যায়। মাসুদ আমার ঊরুতে কনুইয়ের ভর দিয়ে মাদুরে বসে থাকে। সোহেল আর জাহিদ দড়ি হাতে রুবেলের মাথায় দিকে দাঁড়ায়, কাদের পায়ের দিকে। সোহেল দড়ির মধ্যেখানে ফাঁস তৈরি করে।
ছুরির ধার একবার পরখ করে নেয় কাদের। টেকো ভদ্রলোকটি তখন অঘোর ঘুমে, তার নাকের শব্দকে গর্জনের মতো লাগছিল। সোহেল আস্তে মাথাটা উঁচু করে রুবেলের গলায় ফাঁস পরিয়ে দেয়। মাসুদ উঠে রুবেলের কপালে একটা চুমু দিয়ে আসে। ওর অপরিবর্তনীয় অবয়ব লক্ষ করে বুঝতে পারি না, এটাও ব্যঙ্গ কি-না। দড়ির দুপ্রান্তে সোহেল আর জাহিদ। কাদের পায়ের কাছে ছুরিটা রেখে রুবেলের পায়ের ওপর আলতোভাবে হাত রাখে।
গলার কাছে কী যেন একটা দলা পাকিয়ে আসতে চায়- আমি অনুভব করি। দুঃস্বপ্নে দেখা প্রেতাত্মার মতো লাগে সবাইকে। না-কি আসলে আমি একটা ভয়স্কর দুঃস্বপ্নের মধ্যে বাস্তবতা অতিক্রম করে পৌঁছে গেছি বুঝতে পারি না। স্বপ্নের এই কারখানার মাঝে বসে আমার গলা শুকিয়ে আসে। কখন থেকে যেন প্রতিটি শব্দ দু‘তিন বার করে শুনতে আরম্ভ করেছি। ফলত যা শুনছি, স্পষ্ট হয়ে উঠছে না। কিন্তু শব্দ হচ্ছে, শব্দ উঠছে কানের চতুর্দিকে চক্রাকারে, টের পাচ্ছি। দড়িতে টান পড়তে রুবেলের বুনো জান্তব স্বর আমার দৃষ্টিগ্রাহ্য দৃশ্যকে ঝাপসা করে দেয়। ছোটোবেলার নাগরদোলা চড়তে গিয়ে শূন্য থেকে নিচের দিকে নামার কথা মনে পড়ে। শরীরের কোনো ভার থাকে না; মনে হয় নামতে নামতে একেবারে পৃথিবীর বুক ফাটিয়ে কেন্দ্রে গিয়ে পড়ব বুঝি। চোখ খুলে চাওয়া যায় না। সিগারেট ধরিয়ে স্বাভাবিকতা দেখাতে গিয়ে আমি সিগারেট ম্যাচ মাদুরের ওপর বমি উগরে দিই। মাসুদ এক হাতে আমাকে ধরে অন্য হাতে পিঠ বুলিয়ে দেয়। ওকে তখন দৈত্যের মতো লাগে। তাকাতে পারি না। কে যেন গোঙাচ্ছে, কে যেন মরিয়া হয়ে মেঝেতে হাত-পা ছুঁড়ছে। কারা যেন গোঙানির আওয়াজটাকেও নৈঃশব্দ্যে রূপান্তরের জন্য মুখে কাপড় ছিঁড়ে গুঁজে দিচ্ছে। কে যেন একবার ধপ করে উল্টে পড়ে গেল। ধস্তাধস্তির প্রচণ্ড শব্দের মধ্যে দিয়ে ঘড় ঘড় শ্বাসপ্রশ্বাসের অবাস্তব শব্দ…
‘মাসুদ’ আমি উদ্দেশ্যহীন ওকে ডাকি। জানি আর কোনো নিস্তার নেই আমার। যতোক্ষণ না ওর ইচ্ছা হয় আমাকে আবার ফিরিয়ে দিয়ে আসার। অবশ্য আমাকে অবহেলা করে না ও
দাঁড়া, তোকে মুছিয়ে দিই আগে
পর্দার কাপড় ছিঁড়ে ও আমাকে মুছিয়ে দেয়
ওকে কি জবাই করবি?
না, ওর কাজ শেষ। চেয়ে দেখ, ওর হাত-পায়ের রগগুলো কাদের এখন কাটছে
আর কী করবি ওকে?
না, আর কিছু নয়, ফাঁসের দড়ি দিয়েই টেনে টেনে ওই পাশের ঘরের কোণে একটা কুয়ো আছে- তাতে ফেলে দেব। ভীষণ খাদ কুয়াটার, নিচে পানি নেই
তারপর?
তারপর আর কী? দিনের বেলাও এখানে আলো আসে না। আর কুয়োর ভেতর তো কথাই নেই।
পচবে না, গন্ধ বেরুলে?
কিছু মেঝের ভাঙাচোরা ইট আর ওই পাশের আবর্জনার মাটি ফেলে দেব। তাছাড়া এখানে আমাদের আজকের এই আড্ডাই শেষ আড্ডা
ওকে ফেলে দিয়েই তোরা চলে যাবি?
মাসুদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। ওর চোখে মুখে তখন অনতিস্পষ্ট বিষণœতার ছায়া। এরপর আমার কানের কাছে সরে এসে ও ফিসফিস করে
আজকের রাতটা ছিল ভুলের রাত, আমার জন্য বড়ো অবিবেচনার রাত! আরেকটু সচেতনভাবে এগুনো উচিত ছিল আমার। টেকো শুয়োরের বাচ্চা আমার সঙ্গে চমৎকার প্রতারুা করেছিল যা আমি তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারিনি। এই রাত শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সোহেল নিখোঁজ। পরে জানতে পেরেছি ও জার্মানে পালিয়েছে। আসলে রুবেলের সঙ্গে টেকো কুত্তার কোনো কন্টাক্ট হয়নি। আর রুবেল আমার ডান হাত। কিন্তু গোপনে গোপনে কিছু ছোটখাট গ্রুপের জন্ম হয়ে যায় ইতোমধ্যে। বয়স অল্প হলেও এরা আমাদের চেয়ে অসহিষ্ণু আর মালিকদের কাছে এদের দাবিও থাকত কম। ফলে ওরা মনেপ্রাণে আমাদের গ্রুপটাকে ভাঙতে চাচ্ছিল। কেননা স্থানীয় বাজারে দাপট রাখতে আমাদের ছাড়া ওরা কোনোভাবেই পুলিশের ওপর নির্ভর করতে পারে না। কাজেই টেকো কুত্তা শলা-পরামর্শ করে সোহেলকে দু’লাখ সমেত জার্মানির একটা টিকিটের পরিবর্তে রুবেলের আজকের পরিণতিটা ও পাকা করে ফেলে। আমার ডান হাত রুবেল। আমাদের গ্রুপ ভাঙতে ব্যাপারটা বেশ কাজে লাগল। রুবেলকে আমরা সবই মিলে খতম করলাম, পরদিন ভোরের ফ্লাইটে সোহেল জার্মানির পথে। কাদের অন্য একটা গ্রুপের খপ্পরে আগেই শেষ। পরের রাতে টেকোর পরিকল্পনা ছিল যে কোরেই হোক আমাকে শেষ করবে। ব্যাপারটা পরের দিন দুপুরে জানতে পেরেই আমার জেদ চেপে বসে। ওই কুত্তার বাচ্চাই ব্যবসার পার্টনার করার লোভ দেখিয়ে ওরই ব্যবসায়িক স্বার্থে আমাদের তৈরি করেছিল। এবার আমাদের শেষ করে অন্য একটা গ্রুপকে তুলতে চাচ্ছে। ওকে জবাই করার নেশা আমাকে পেয়ে বসে। আমি অকস্মাৎ দুপুরের আগে ওর কাছে গিয়ে চমৎকার এক পার্টির প্রস্তাব দিই খোশ মেজাজে। যেখানে মাত্র আমি, জাহিদ আর টেকো থাকবে।
বাজি, কে কতো টিন বিয়ার টানতে পারে। তিনটের পরেই প্রোগ্রাম, এখানে ও আমাকে মারতে চাইলেও নিশ্চই গভীর রাতের অপেক্ষা করবে। আমি তার আগেই কাজ সেরে পালাবা
পালাতে পেরেছিলি?
ওর কাহিনী জটিলতর অবস্থায় প্রবেশ করলে আমারও নতুন কৌতূহল দানা বাঁধে। জেদী পুরুষ অনভ্যস্ত ব্যর্থতার মুখোমুখি হলে যে রকম মুখভঙ্গি করে ঘাড় গুঁজে থাকে, মাসুদ আমার এ প্রশ্নে মাথা নিচু করে রইল খানিকক্ষণ।
মাসুদের এই মুহূর্তের মানবিক চেহারার দিকে তাকিয়ে আমার মন বেদনাতুর হয়ে ওঠে। নষ্ট শশার মতো এই সব পরিত্যক্ত ভুতুড়ে জীবন আর জীবনের অপব্যবহার আমাকে কোথায়, কাদের ওপর যেন, ঘৃণা বর্ষণ করতে বাধ্য করে। কী ভীষণ চোরাবালির ওপর নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে আছি আমরা!
তখনই রুবেলের লাশ ফেলে জাহিদকে ফিরতে দেখে আমি বুঝতে পারি এবার পরের দিনের মহড়া শুরু হবে।
মাসুদ বলে যায়, পরের দিন তিনটে থেকে আমি জাহিদ আর এই কুত্তাটা ছিলাম এখানে। আর কেউ না। কৌশলে ওর প্রতিটা টিনে দু’তিনটে মেনড্রাগস ছেড়ে দিয়েছিলাম আমরা। সন্ধ্যে ছ’টায় কুত্তা এখন যেভাবে নাক ডাকছে এরকম ঘুমে ঢলে পড়ে
তারপর- আমি প্রশ্ন করি। বমির পর খুব একটা সহজ হয়ে উঠতে না পারলেও আমার ভেতরে রোমাঞ্চকর শক্তি ভর করে। এইসব নির্মমতার- আমাদের প্রতিদিনের বাস্তবতাও বটে- চাক্ষুষ প্রমাণ পেলে আমি ছেড়ে দেব কেন? সামাজিক ব্যভিচারের এই অনিবার্য দৃশ্যাবলি যার ঘোরতর হাত থেকে আমাদের মতো নিরীহরাও হয়তো একদিন নিস্তার পাবে না। এরকম একটি উপলব্ধি আমাকে সম্মোহিত করে। দেখতে হবে আমাকে, সম্পূর্ণটুকুই।
অতএব আমার ‘তারপর’ প্রশ্নে উঠে দাঁড়াল মাসুদ: আমি আবার নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকায় টানটান হয়ে তাকিয়ে থাকি…
ওর দেখাদেখি জাহিদও উঠে দাঁড়ায়। চৌকির অদৃশ্য খাপ থেকে আঁকাবাঁকা দীর্ঘ ছুরি বেরিয়ে আসে। মাসুদ ঠিক মাথার দু’পাশে দুটো পা স্থাপন করে টেকোর চেহারা দেখতে দেখতে অশ্লীল খিস্তি ছাড়ে। আর জাহিদ ঘুমন্ত লোকটার বুকের দুদিকে দু’পা দিয়ে মাসুদের মুখোমুখি দাঁড়ায়, হৃদপিণ্ড বরাবর ছুরি ধরে থাকে। মাসুদ টেকোর কপালে গোল টিপের মতো একটি বৃত্ত ছুরির ডগা দিয়ে কাটলে টেকো চোখ খোলে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ও হুড়মুড়িয়ে উঠতে গেলে জাহিদ দু’হাতে বাঁট ধরে হৃদপিণ্ড বরাবর বসিয়ে দেয়। ‘ভুস’ করে একটি শব্দের সঙ্গে পিচকারির মতো রক্ত ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিক। আর শুরু হয় তার দৈত্যের মতো শরীরের ছটফটানি। বিদ্ধ ছুরিটা জাহিদ ওই অবস্থাতেই পেটের ডান-বাম ওপর-নিচ মোচড় দিয়ে লণ্ডভণ্ড করতে থাকে। ছুরিবিদ্ধ অংশ ও তার মুখ থেকে যে ব্যাখ্যাহীন বীভৎস আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছিল তার সঙ্গে সঙ্গে আমি বোধ করি কয়েক মুহূর্তের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। কেবল কয়েক মুহূর্তের জন্যই। কেননা আমার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠেছিল এবং মোমবাতির আলোড়িত তুমুল শিখায় আমি এই জটিল জগতের প্রকৃত অর্থ কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। দেখলাম, মাসুদ অসহিষ্ণু হাতে জাহিদের জান্তব সহায়তার টেকোর গলায় অবিরাম ছুরি চালাচ্ছে। প্রথম প্যাঁচে ওপরের চামড়াটা সরে যেতেই দুধের মতো শাদা একটা পাতলা পর্দা, এরপর কণ্ঠনালী, রগ শিরা উপশিরা স্নায়ুগ্রন্থি ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন পেশীসমূহের বাধা অতিক্রম করে ছুরিটা ধীরে ধীরে গলার একেবারে নিচে অস্থিতে গিয়ে ঠেকল। এরপর বোধহয় ওরা দুজনে একই সঙ্গে লাশের শরীর থেকে লাফিয়ে সরে এলে অপ্রাকৃত দেহটি জন্ম-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের তাণ্ডব শুরু করল যেন…
এরপর জাহিদ বাইরে গেল। মাসুদ প্রাণীটার স্থির হয়ে আসা বিসর্পিল শরীরের ওপর পেচ্ছাব শুরু করল। লোকটার খোলা চোখ দুটো তখন সিলিঙের অন্ধকারে নিবিষ্ট। নিচের চোয়ালটা ওপরের দিকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন। খোলা ঠোঁটের মধ্যে তখনো পান-সুপারির দানা পেচ্ছাবের পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে…
পেচ্ছাব শেষে ‘এরপর’ বলে মাসুদ আমার দিকে তাকায়। সে চোখে করুণ নিঃস্বতা, যেন পৃথিবীর কোনো কিছুতেই আর কিছু যায় আসে না- এমন শুষ্ক মুখভঙ্গি করে ও আমার দিকে তাকায়:
আমার পরিকল্পনার প্রায় শেষ মুহূর্তে টেকোর নতুন গ্রুপ এখানে এসে পড়েছিল। জাহিদ পালাতে চেয়েছিল ওদের উপস্থিতি টের পেয়ে। পারেনি। কাপড়ে রক্তের দাগ ছিল কি-না। আর ওরা… ওই যে, ওরা আসছে- ওরাই আমাকে কমলাপুর…
মাসুদ শেষ করতে পারে না-পাঁচ ছ’টা ছেলে, ওদের থেকে বয়সে অনেক কম, পনেরো থেকে আঠারোর ওপর কিছুতেই যাবে না; ছুরি, ড্যাগার, চাপাতি হাতে টেকোর লাশ দেখে বিনা বাক্যব্যয়ে মাসুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে…
অতগুলো যুবকের ভেতর থেকে আমি আর মাসুদের শরীরকে আলাদাভাবে সনাক্ত করতে না পেরে টালমাটাল পায়ে, এক দৈব স্মৃতির ওপর ভর করে, সে-ই পথ, অন্ধকার গহ্বর, সেই ইঁদুর আরশোলা চামচিকে, ড্রেনের উপচে ওঠা পানি ভেঙে, যেন কতোকাল পরে আমি হাঁটছি, টলতে টলতে স্বাভাবিক শব্দেও চমকে উঠে একটি পরিচিত দরজার দিকে এগুতে থাকি। সমস্ত রোমক‚প ফুঁড়ে একটি জিজ্ঞাসাই যেন সহস্র গলায় প্রতিধ্বনি তুলে আমার চতুঃপার্শ্বে চক্রাকারে চিৎকার করতে থাকে:
এই অন্ধকার বিলীন হলে ভোরবেলায় আমিও কি নিজেকে কুয়োর মধ্যে কখানো আবিষ্কার করবো না? যার গলার ফাঁস আধ ইঞ্চি দেবে গেছে, যার হাত পায়ের রগগুলো কাটা, রক্তাক্ত…
কিংবা কপালে যার ছুরির ডগার বৃত্ত, হৃদপিণ্ডে ঢোকানো নিরেট ছুরি, যার গলা গরুর মতো জবাই করা…
কিংবা ক’জন যুবকের ছুরি, ড্যাগার চাপাতিতে ছিন্নভিন্ন একটি শরীর যাকে কমলাপুর স্টেশনের পাশে পচা পুকুরে ভেসে ভেসে পচার জন্যে ওরা একটু পরেই ফেলে আসবে?
অন্ধকার বিলীন হলে আমি কোথায় জেগে উঠব?…