কবিতা 

মাহমুদা তাহিরা’র চারটি কবিতা

১.

শামুকের প্রবৃত্তি

 

দিনমান ধরে —

মেঘাচ্ছন্ন সাংসারিক আয়নায় চলে বৈরাগী বুদ্ধ হয়ে উঠবার প্রবল তাড়না,

কিন্তু যশোধরার চোখের দিকে চোখ রেখে, দূরদ্বীপের গান গাওয়া যায় না।

 

রাত্রি হলে —

বিড়ালের ওমের ভেতর বিষাদের চাবি সেধিয়ে রাখি,

তবু অন্ধকার ভয় লাগে, চোখ ছোট রেখে সন্দেহজনক চেয়ে থাকি।

 

একমাত্র তোমাকে —

অবলম্বন হিসেবে পকেটে হাতড়ে পেলে পেটভরে ভাত খাই, দিয়াশলাই ভেবে আঙ্গুলের ডগায় আগুন জ্বালাই,

ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা আজো ভুলিনি।

 

নিজেকে, খুঁজে না পেলে —

হাঁটুজলা নদীর বয়ে যাওয়া দেখি, সন্ধ্যের কিনারে ঘর গুটায় শামুকের প্রবৃত্তি, আশেপাশে ভাসতে থাকা সাদাকালো পাতিহাঁসের চোখকে তুলনামূলক সহজ লাগে; মাথায় অন্তত তেল দেওয়া উচিত ভেবে, ঘরের মানুষ হয়ে ঘরে ফিরে আসি।

 

 

 

২.

স্বদেশ

 

তবু দেখি জলেতে খেলা করে — মাছরাঙা পাখি, আর মাছ উঠে যায় আকাশে — রাঙা পাখির ঠোঁটে। তবু দেখি নখের আঁচড় খাওয়া ঘাড় ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে উঠে ফের, বুক উঁচু করে এসে দাঁড়ায় পিঠে — স্বদেশের গ্রাফিতি এঁকে।

এখনো ভোর হয় অনিরুদ্ধ, এখনো এদেশে কিছু লাল ফুল ফুটে।

 

 

 

৩.

পাহাড়ি চিঠি 

 

চোখের সামনে প্রায়শই

একটা পাহাড়ি চিঠি উড়ে বেড়ায় নেরুদা,

তাকে ধরতে গেলেই মেঘ হয়ে ভাসতে থাকে ঈশানে।

একটা ভিন্টেজ পেপারের মৃদুমন্দ চিঠি নেরুদা,

বয়ে বেড়াচ্ছে আমাদের যাবতীয় প্রেম,

একদিন পাহাড়ে হাত চেপে পাশাপাশি

বসে থাকার মদিরা মাতাল উন্মাদনা।

একটা মাটি মাটি গন্ধের চিঠি নেরুদা,

আঁকড়ে ধরছে ঘাড়, ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে দিচ্ছে পা,

উসকে দিচ্ছে আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে দেখা

হাত ফঁসকানো এক জ্বালাময়ী স্বপ্নের,

যা আমরা দেখেছিলাম পাহাড়ি বৃষ্টির আলোয়।

একটা দুই পাতার ছোট্ট চিঠি নেরুদা,

বাড়িয়ে দিচ্ছে সন্ধ্যা, কমিয়ে দিচ্ছে আলো,

নাড়িয়ে দিচ্ছে স্মৃতি, জুম ক্ষেতে ভালোবাসাবাসি

শেষের আমাদের এক ক্লান্ত শ্রান্ত বিবাদ।

আমি এই একটা চিঠি ছুঁয়ে দেখবার আশায় রীতিমতো গারো পাহাড়ের আদিবাসী বনে গেছি নেরুদা, মাচায় বসে বুনে ফেলেছি আজন্ম কালের ঘর,

তুমি কেন একা চলে গেলে নেরুদা,

তোমায় কিভাবে ডেকে নিয়ে গেলো ঐ স্ফুলিঙ্গের শহর?

 

 

 

৪.

বর্ষাকালীন সংজ্ঞা

 

এক বৃষ্টির দিনে…

ফুল — বেলী আর গন্ধরাজ কি সমগোত্রীয়? এইসব সাদা ফুলের কোটরে বৃষ্টিকে লাগে বেশি ট্রান্সপারেন্ট। মৌমাছি তার ডানায় করে, পুংরেণু নিয়ে বালখিল্যতায় উড়ে, যদিও আজ গর্ভাশয়ে বাঁশঝাড়ের অন্ধকার, তাই স্বচ্ছতার বাগানে গাও সুললিত গান। তুলনামূলক বেশি ফুল আজ ফুটতেও তো পারে।

উদ্ভিদ — জলজ বেশি নিকটাত্মীয়। বৃষ্টি এলে বিলে নামি। ঝাঁঝি শ্যাওলার দল শরীরে বায়, হাইড্রিলাও থাকে কাছাকাছি। তুমুলধারে প্রার্থনা করি বৃষ্টির। একটি প্লাবিত দেহাবশেষ, পায়ে প্যাঁচানো কল্পিত মেডুসা আর ঝপাঝপ বৃষ্টি মিলে আলাপ করি পরবর্তী অবগাহন কেন্দ্রিক। মেঘের উচ্চতার এক লাইটহাউজ থেকে কনে দেখা আলো আসে সন্ধ্যা ভেদ করে। দেখি জীবন মন্দ নয় — সাদামাটা, আশাব্যঞ্জক এবং প্রাবন্ধিক বৃষ্টিবহুল।

পাখি — উঠানে বৃষ্টি পেলে, সমস্বরে ক্রন্দনরত পাতিহাঁসেরা বাড়ি উঠে আসে, আর সাদা রাজহংস নামতে থাকে জলে। দলভুক্ত হতে বলো কার না ভালো লাগে? যদি জায়া আজ তাকে ফেলে উজানে ভাসতেও থাকে, এবেলায় বরং তার খোঁজ করা যাক। চারিধারে দেখো আজ, জীবনানন্দভিত্তিক অঞ্জলি। ধৈঞ্চার দেহ দুলে দুলে উঠছে, দু’ভাগ করে কেটে চলছে ৎ-আকার সফেদ হংস, যদিও জায়ার খোঁজে গন্তব্যহীন, তথাপি আশায় বুক বেঁধে তিরতির করে কেঁপে। পাখি হয়ে ডানা থাকলেই উড়া যায়? দেখো হংস-হংসীর কেউ কেউ কারো খোঁজে আকুল হয়ে ভাসছে নদীর কিনারায়। এবার প্রশ্ন — তারা একে অপরকে খুঁজে পাবে? এই বৃষ্টির দিনে, ধরে নিই, পেয়েছে।

Related posts