গদ্য 

ধরা যাক দু’একটা ইঁদুর এবার—।। হাসিন এহ্সাস লগ্ন

বার্জার পেইন্টের ঝাঁঝালো ঘ্রাণ আমাকে সবসময় টানে। নেইলপলিশ আর স্পিরিট। কাঠের দোকানের পাশ দিয়ে যাবার সময় বার্নিশ। ছোটবেলা থেকে এখনও অবধি নেইলপলিশ খাই। এলোপাতাড়ি মেখে থাকে ঠোঁটের আশপাশে। ওই ছোটবেলায় ছেঁড়া জুতার বিনিময়ে কটকটিঅলার পেছনে ছুটতে ছুটতে, কিংবা কাকের নিয়ে যাওয়া সাবানের পেছনে দৌঁড়োতে দৌঁড়োতে একসময় দেখলাম আমার ভালো লাগছে না। কিছু করছি না। কোথাও যাচ্ছি না। সেসময় এক বন্ধু জুটে গ্যালো। সে বলছে, my weariness amazes me. সে নাকি বিধ্বস্ত কোনো ভাঁড়ের সুর নিয়ে আর ভাবতে চায় না। তারপর একদিন পেলাম অন্যজনকে। ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?

চমৎকার!

ধরা যাক্ দু’একটা ইঁদুর এবার—’

এসবের বহু পরে প্রেমিক যখন বলছে ‘আমি মরে গেলে তুমি আসবা না?’ কালেক্টরেট মাঠের ঠা ঠা রোদে দাঁড়িয়ে আমার তখন সেসবই মনে পড়ছে। মুহূর্তেই তার মখমলের মতো পেলব আঙুল ফড়ফড় ক’রে ভস্মীভূত হ’তে দেখলাম। সে যদি তার নীল মার্বেলের মতো চোখগুলো কাওকে দিয়ে যায়, আর তার সাথে আমি মাঝেমধ্যে দেখা করি, তাহলে কেমন হবে, তা নিয়ে বলতে শুরু করলো। আমি ভাবতে লাগলাম পার্সিয়ানদের টাওয়ার অব সাইলেন্স কিংবা টিবেটানদের স্কাই ব্যুরিয়ালের কথা। অনেক আগে একবার মাভেরিক বলছিলো তার নাকি বারবিকিউ হ’তেই বেশি ভালো লাগবে। আর বলছিলো, মরে যাবার পর শরীরের কোষগুলো ধ্বংস হ’তে শুরু করে, আর ব্যাকটেরিয়ারা পচন প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে। এই পচন থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, হাইড্রোজেন সালফাইড, অন্যসব গ্যাস তৈরি হয়। শরীরের ভেতরে এইসব গ্যাস ধীরে ধীরে জমা হতে থাকে, বিশেষত যদি কোনো প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম উপায়ে তা বের হওয়ার পথ না থাকে। পেটের নরম টিস্যুতে চাপ বাড়তে থাকে। যখন চাপ সহ্য করার ক্ষমতা ছাড়িয়ে যায়, তখন সেই অংশ ফেটে যায়। এভাবে মিথেন আর ফরফিন মিলে অনেকসময় আলেয়া তৈরি করে। তখন আমরা পরীর মতো নেচে বেড়াবো। ময়ূরকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে ক’রে, সে বড় হ’তে হ’তে অনেক বড় হ’লে ব্রহ্মদৈত্য হবে কিনা। আর আমি কি তখন আলেয়ার ফেইরি হয়ে ওর কাছে যাবো? নাকি মহিলা-মামদো হবো?

মাভেরিক বলছিলো, ক্রিমেশান জুয়েলারির কথা। প্রিয় কারোর গলায় ছাইয়ের লকেট হয়ে ঝুলে থাকার কথা। যেভাবে গাছের সাথে মৃহদেহ ঝুলিয়ে রাখে আফ্রিকার এক সম্প্রদায়। শুধু ওইদিন কালেক্টরেট মাঠেই না, এরকম মৃত্যুগন্ধী শীতল সন্ধ্যাতেও আমার সেসব মনে পড়ে। খুব ভালো লাগে সবকিছু। মনে হয় মরে যাই। সুনীল সাইফুল্লাহ্’র মতো সবুজ পায়রার হৃদপিণ্ড খুঁজতে ইচ্ছে করে। কুমার চক্রবর্তীর ‘অস্তিত্ব ও আত্মহত্যা’র পাতা ওল্টাই। আবার ইচ্ছে হয় ফুড ভ্লগিং করি। ময়ূরের ঠোঁটের। বলি, ‘হ্যালো গায়েস্!

… তো এটা খুব টেন্ডার আর জুসি।’ ইচ্ছে করে অনেক অনেকক্ষণ ধরে চুষতে আর কামড়ে ধরে রাখতে। আর কিছুই না, সত্যি! তারপর আবার মরে যেতে চাই। চাইতে চাইতে রিকশায় উঠি। রিকশা ব্যস্ত ব্যস্তসব রাস্তা পেরিয়ে যেতে থাকে। পেরোয় সপুরা গোরস্তান। যেখানে অরুণের জন্মনাড়ি পোঁতা। এই এক কথা আগেও বলেছি। ভালোই লাগে। সেই কবে আমি খুঁজতে চেয়েছিলাম কোন্ ‘বিপন্ন বিস্ময়’ আমাদের ক্লান্ত করে, তার হদিস। সেদিন কি আমি ইলিশ খেয়েছিলাম? জেলেদের জালে, আর বঁড়শিতে একের পর এক তেলাপিয়া উঠতে দেখে ক্লান্তবোধ করতাম যখন, তখন বাঁশের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমি। বিনয়ের ভুট্টা সিরিজ পড়তে পড়তে, তলকুঠুরিতে ভুট্টা আর দ্রাক্ষারসাস্বাদনের কথা মনে হ’লে সেসব মনে পড়ে। ময়ূর চায় না ওকে ময়ূর বলি। ময়ূর শব্দটা নাকি ওর সামনে ময়ূখরঞ্জনকে নিয়ে আসে। কবে কোন সিঁড়ির নিচে এক ক্লেদজ-ক্লাউন নাকি বলেছে আমি খুব তাড়াতাড়ি হাত কাটাকুটি খেলবো। ওই জিনিস আর করা হয়নি কখনও। শুধু তেঁতো অ্যান্টাজল আর নেইলপলিশ গিলেছি। গিলতে গিলতে মরে গেছি। মরতে মরতে অস্ফূটে কিছু শব্দ বোধহয় বলেছি। সেসব হয়তো কিছুটা মোনের মতো শুনিয়েছে। কী দুর্দান্ত লিখতো সন্দীপন!

“না-না-না। নোংরা বাথরুমের ভেতর সেদিন হয়েছিল যে—কোনও পশ্বাচারকেও তা করবে অধোবদন। না-না। ছিঃ। ঐ নোংরা বাথরুমের মধ্যে কখনই না। একবার তো প্রথাবিরোধী কমোডাসনেও বসতে হয়েছিল।

সত্যি সিদ্ধপুরুষ। কলকাতার ঠিকানা নেননি। যখন ধরণীধর তা দিতে চায়। ‘গঙ্গামাইয়া চাইলেই, তোমরা আবার আসবে।’ বলেছিলেন, ‘ঠিকানা আমি নিই না। ঠিকানা বড় পিছুটান।’

তখন সন্ধ্যারতির প্রস্তুতি চলছে। উঁচু মৃগচর্মাসন থেকে বাগীশ্বর যখন বললেন, ‘মা-মা। এঁরা হলেন সাক্ষাৎ পার্বতী। যতক্ষণ এইখানেতে এঁদের রুনুঝুনু-বাম স্তনের নিপল-এর ওপর তর্জনী রেখে দেখিয়ে দিলেন কোনখানে, ‘ততক্ষণই আমরা শিব।’

লালপেড়ে কড়িয়ালে ঢাকা শরীর উপুড় করে প্রভুর পায়ে তখন তাঁর সর্বস্ব ঢেলে দিচ্ছেন শতরূপা, কারণ তিনি ততক্ষণে টের পেয়েছেন, তিনি যে মা হতে পারেন তা প্রমাণিত হতে চলেছে। তখনই কী করে টের পেয়ে গেছেন, তা কে বলবে। গর্ভসঞ্চারের প্রথম লক্ষণগুলো দেখা দিতে তখনও দু-সপ্তাহ বাকি। হরিদ্বার, হৃষীকেশ, কনখল কি কেদার-বদ্রির পথে কেউ মাছ-মাংস স্পর্শ করে না। নারীও একপ্রকার মাংস। ধরণীধর মাসাধিককাল নারীমাংসকেও তাই সেই কুখাদ্যের তালিকায় রেখেছিলেন। পিতৃত্ব-সংবাদের আকস্মিক উন্মাদনা সে-কথা মনে রাখতে দেয়নি।

তবে না। কিছুতেই না। বাথরুমে নয়। বিপ্লবী বাথরুমে জন্মগ্রহণ করে না। বিপ্লবের প্রতিশব্দ একটাই। আগুন।”

তীক্ষ্ণ মনোযোগের সাথে এইসব পড়া হ’তো। এখন আর ভালো লাগে না। যেমন ভালো লাগে রাগমোচনের পর গুটিসুটি মারা ক্লিটোরিসের সাথে বোঝাপড়া। সবকিছুই চমৎকার। চমৎকার! চমৎকার!

‘হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজও চমৎকার?’

Related posts