কবিতা 

মদসংখ্যা- রস খাইয়া হইয়া মাতাল ।। ‌‌অসীম নন্দন

[গল্পের সকল চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক। বাস্তবতার সাথে মেলাতে গেলে লেখকের কোনো দায় থাকিবে না; দায় কেবল এবং কেবলমাত্র পাঠকের!]

আমরা বহু বহু বছর আগেই মিথোলজি থেকে স্বর্গলোক, মর্ত্যলোক এবং পাতাললোকের ধারণা পেয়েছি। ধারণা বলতে শুধু ধারণা নয়। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। একেবারে ছবিসহ! পৃথিবীতে আছে হাজার হাজার ধর্ম এবং মিথোলজি। তবে এই তিনটি ‘লোক’ সম্পর্কে প্রায় সকল মিথোলজির ধারণায় বিশেষ সামঞ্জস্য আছে। যেন এক বন্ধুর বাড়ির আর্কিটেক্ট এবং ইন্টেরিয়র দেখে আপ্লুত হয়ে, অন্য আরেক বন্ধু সেই ডিজাইনে হালকা পরিবর্তন এনে, একই রকমভাবে নিজের বাড়িটিও তৈরি করেছে। হয়তো পশ্চিমের দেয়ালটা বন্ধুর পছন্দ মতো নীল-রঙা না করে, নিজের পছন্দের হালকা সবুজ রঙে নিজস্বতার পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করেছে। তবে কোনো মিথোলজিতেই আপনি যে জায়গাটার কথা কোথাও পাবেন না, সেটা হলো বারামখানা।

বারামখানা একটি অত্যন্ত সুন্দর মনোরম পরিবেশের আধুনিক রুচিসম্মত পাব। না, এইটা আর পাঁচটার মতন সাধারণ নয়। এই পানশালার মাথার উপরে ছাদ নেই। নক্ষত্রখচিত আকাশের গায়ে কোনো টক টক গন্ধ নেই। বসার জন্য চেয়ার-টেবিল নেই। আছে শীতলপাটি। গেইটে দাঁড়িয়ে কোনো দারোয়ান সালাম ঠুকে পয়সা চায় না। এইখানে সর্বদা ভাতৃত্ববোধ বিরাজ করে। এইখানে প্রবেশ করলেই মনে হবে অস্তিত্বশীল এবং অনস্তিত্বশীল সকলেই যেন কত জন্মের পরিচিত। দুই পেগ পেটে পড়তেই এইখানে সকলকে আপনজন মনে হয়। নিচ্ছিদ্র ব্রাদারহুড চলে আসে আত্মার মধ্যে। বুকের ভিতর কেবল অম্বুরি তামাকের গন্ধ ছড়ায়। এইখানে কেউ গরীব নয়, কেউ ধনী নয়, কেউ প্রভু নয়, কেউ দাস নয়। এইখানে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়। কোনো জাতিসংঘ নাই। এইখানে আনন্দের অনন্তধারা। বারামখানায় অবশ্য সকলেই প্রবেশ করতে পারে না। প্রবেশের জন্য চাই একটি বিশেষ সার্টিফিকেট। পৃথিবীর হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে পাওয়া যায় সেই বিশেষ সনদ। ডেথ-সার্টিফিকেট। গেইটে দাঁড়ানো দারোয়ান কেবল ঐ সনদপত্রটাই চেক করে। তাছাড়া এইখানে আর কোনো বাঁধা-ধরা নিয়মকানুন নেই। আর সনদপত্র ছাড়া এইখানে কারো বেইল নাই। মানে মূল্যায়ন নাই আরকি।

কোজাগরী পূর্ণিমা রাতে আজ বিশেষ পার্টি চলছে বারামখানায়। অনেক গণ্য-মান্য, সুখ্যাত-কুখ্যাত এবং অতি সাধারণ আত্মার গণ-সমাবেশ। মাঝেমধ্যেই এমন পার্টি চলে। প্রথম দেখায় হয়তো মনে হতে পারে একরকমের ওয়ার্ল্ড সামিট চলছে। তবে পার্থক্য হচ্ছে, এইখানে সাধারণ খেটে-খাওয়া-ছাপোষা কেরানিশ্রেণি থেকে কবি-লেখক-গায়ক-রাজনীতিবিদ সকল প্রকারের ভাবুক আত্মারাই আমন্ত্রিত। বিচিত্র সংস্কৃতির আত্মারা মিলিত হয়েছে একটি সমাবেশে। সমাবেশের মাঝে একটা স্টেজ। আর স্টেজটা ঘিরে সিড়ির মতন থাকে-থাকে সাজানো শীতল পাটিতে সবাই নিজের নিজের খুশি মতো আসন গ্রহণ করেছে। কেউ কেউ তো বাঙলাদেশের রাজা-বাদশা-নবাব-জমিদারদের মতো শীতলপাটিতে গা এলিয়ে আরামে শুয়ে শুয়ে সুরা-পান করে।  স্টেজে যে-কেউ নিজ নিজ শিল্পের পারফরম্যান্স দেখাতে পারে। নিজ নিজ ভাবনার কথা, বিশ্বাসের কথা, আক্ষেপের কথা, সমালোচনা এবং আত্মসমালোচনা শেয়ার করতে পারে।

স্টেজে বর্তমানে রুমি কবিতা আবৃত্তি করছেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে বিথোভেনের ফিফথ সিম্ফনি হালকা ভলিউমে বাজছে। একটু আগেই তিনি সুফিদের মতো চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে নেচেছেন। নাচ শেষে রুমি একেবারে গায়কী ঢঙে চোখ বুজে স্পষ্ট উচ্চারণে মাউথ স্পিকারে বলে চলেছেন, “Walk by my grave and you will become drunk…”। দর্শকদের মাঝে ২০২০ সালের মহামারীর আঘাতে শহিদ একজন অখ্যাত হিপ-হপ আর্টিস্ট অবাক হয়ে ভাবেন। এইটা তো একেবারে আল্ট্রা-মডার্ন আর্ট পারফরম্যান্স। তার মানে ৮০০ বছর আগেও হিপ-হপ আর্টফর্ম ছিল। হিপ-হপ আর্টিস্ট জয়েন্টে একদম দিয়ে নিজের ভাবনার ইতি টানেন এই ভেবে, কবিতা তো বহু পুরোনো আর্টফর্ম; তাই এতে এতো বিস্মিত হবার কিছু নাই। উপস্থিত সবাই গভীর মনোযোগে রস পান করছেন। কেউ কেউ তো মদের সাথে কবিতা মিশিয়ে ককটেল পান করছেন। সকলের অলক্ষ্যে থেকে বাঙলাদেশের এক দুর্ভাগাতম কবি নিজের মনেই ভাবেন। কবির নাম জীবনানন্দ। দুর্ভাগাতম হবার একটাই কারণ, পৃথিবীর ইতিহাসে ট্রামে চাপা পড়ে নিহত ব্যক্তি কেবল তিনিই একজন। যাকে বলে একেবারে পঞ্চম! কবি ভাবেন, ইস! তিনি যদি রুমির মতো কিয়দংশও স্টেজ-পারফর্মেন্স করতে পারতেন! আবার ভাবেন, পাশে বসে থাকা কুসুমকুমারী’কে(কবির মা) তিনি তাঁর আক্ষেপের কথা কি জানাবেন? পরক্ষণেই ভাবেন, নাহ এরকম কথা মাকে জানানোর কোনো মানে নেই। তিনি আর ছোট খোকা নয়। তিনি তো তাঁর মায়ের ‘আদর্শ ছেলে’।

রুমির কবিতা আবৃত্তি শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সিম্ফনির সুর তখনও থামেনি। সিম্ফনির চরম সুরের লহমায় সবাই ভেসে যাচ্ছে। রুমি নিজের মনেই আবারও সুফিনৃত্য শুরু করেছেন। এমন সময় আর্টের তোয়াক্কা না করে, বাঙলাদেশের মন্ত্রীদের মতন ভঙ্গিতে স্টেজে উঠে এলেন দুইজন। একজন নেতা এবং একজন নেতার চামচ(তাবেদার)। তাবেদারের নাম আলিম। জীবিতকালে ছিলেন ড্রাগ-মাফিয়া। এনকাউন্টারে মৃত। আলিম এখন হিটলারের চামচ। আলিম মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, হিটলার যদি ইয়াবা’র প্রসার না ঘটাতেন তবে তাকে পৃথিবীতে নিশ্চিত না-খেতে-পেয়ে মরতে হতো। গুরু-শিষ্যকে প্রথম দেখাতেই ঠাউর করা যায়, বেসুমার মদ এবং ইয়াবা’র নেশা তাদের চোখে জ্বলজ্বল করছে। আলিম খুব ক্ষিপ্রতার সাথে মাউথ-পিসটা নিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে যান্ত্রিক আওয়াজে বলেন, হ্যালো ওয়ান টু থ্রি মাইকটেস্টিং। ভাইসব আমদের দোজাহানের সকলের প্রিয়, সকলের চোখের মণি, ভিন্নচিন্তার অধিকারী মাননীয় হিটলার সাহেব আপনাদের সাথে দুইটা কথা বলতে চান। ধন্যবাদ। এরপরই নৃত্য থামিয়ে রুমি তাঁর নিজের আসনে ফিরে যান। সিম্ফনির আওয়াজ বন্ধ হয়। আর আলিম হাঁটু গেড়ে সম্মানের সহিত মাউথপিসটা হিটালারের হাতে তুলে দেন। যেন এটম-বোমার রিমোট তুলে দেয়া হচ্ছে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির হাতে।
হিটলার এক হাতে মাউথপিস নিয়ে অন্য হাতটা নাৎসি-ভঙ্গিতে উঁচু করে গলার রগ ফুলিয়ে বলেন, বারামখানা জিন্দাবাদ। WAR is PEACE..FREEDOM is SLAVERY… এইটুকু বলার পর হিটলার কিছুক্ষণ থামেন। থামার সাথে সাথে দশদিক থেকে গুঞ্জন শুরু হয়। জনতার মধ্য থেকে অরওয়েল সাহেব দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেন, শুওরের বাচ্চা। এরকম সমাবেশে কেউ যদি বক্তার বক্তব্যে  ভিন্নমত জানাতে চান, তবে ভিন্ন মতাদর্শীকে এরকম চিৎকার করে ‘শুওরের বাচ্চা’ বলতে হয়। এই সমাবেশে এটাই পার্লামেন্টারি রেওয়াজ। অরওয়েল সাহেবের কোটের কোণা ধরে হালকা টান দিয়ে পাশে বসে থাকা হেমিংওয়ে বলেন, ওকে বলতে দেন। হিটলার আসলে কী বলতে চায়? শুনি। অবশ্য আপনার লেখা নভেলের থেকে কোটেশন করে তিনি কথাগুলোকে ভুল ভাবে হয়তো উপস্থাপন করবেন। কিন্তু সেইটা করার এবং নিজের মত প্রকাশের তো হিটলারের পূর্ণ অধিকার আছে। অরওয়েল তাই শান্ত হয়ে বসেন।

হিটলার এবার গলা খাঁকারি দিয়ে আবার শুরু করেন। বলেন, ভাইসব বহু বছর আগে অরওয়েল সাহেব এই কথাগুলো তাঁর নভেলে স্লোগানকারে লিখেছিলেন। তিনি  বাস্তবিকই একজন মহান লেখক। তিনি একদম সত্যি কথা বলেছেন। এখন আপনারা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখেন। হ্যা, পৃথিবীতে এখন ২.৫ মাত্রার বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। যদিও কেউই এই যুদ্ধকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলে ঘোষণা করে নাই। আসলে কানামাছি খেলছে পৃথিবীর সব ডিক্টেটরেরা। তাই আমি এই ভার্সনকে ২.৫ বলে সম্বোধন করছি। রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সমীকরণে বিশ্বের সকল বিগ-ব্রাদারেরা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে যুক্ত হয়েছে। অথচ আপনারা তো কেবল আমাকেই দোষী বলেন। আমি তো ভালা না, আপনারা ভালো লইয়াই থাইকেন। কথার মাঝেই হিটলার আলিমের কাছে পানীয় চেয়ে হাতের ইশারা করেন। ইশারা করতেই আলিম হিটলারের হাতে একটা চিলড বিয়ার তুলে দেন।

বিয়ারে হালকা গলা ভিজিয়ে হিটলার বলেন, অথচ আপনারা আমাকে বলেন ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ যুদ্ধবাজ। মাওবাদী, স্ট্যালিনবাদী কিংবা অটোমানদের থেকেও নাকি নাৎসিরা জঘন্য। নাৎসিদের মতো এরা সবাই তো পৃথিবী থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে আজ কেন পৃথিবীতে যুদ্ধ? আজও কেন পৃথিবীর মানুষ ক্ষুধার্ত? কেন এখন পৃথিবীতে খাদ্য-সংকট দেখা দিয়েছে? এখানে বহু অভিজ্ঞ এবং প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা উপস্থিত আছেন। আপনারা কি কেউ আমাকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারেন? দয়া করে কোনো ইহুদি ব্যক্তি উত্তর দেবার চেষ্টা করবেন না। ইহুদি দেখলেই আমার মদের নেশা কেটে যায়। আমার তখন অন্য নেশা চাপে।

হিটলার চুপ করতেই আবারও গুঞ্জন শুরু হয়। বব মার্লে, জন লেনন এবং জিম মরিসন জনতার মধ্য থেকে চিৎকার করে সমস্বরে বলেন, শুওরের বাচ্চা। তুই স্টেজ থেকে এক্ষুনি নেমে আয়। প্রশ্নের জবাব গুছিয়ে তোকে ভরে দিব। এই কথা শুনে আলিম নিজের মেজাজ ধরে রাখতে পারেন না। হাজার হলেও শিষ্যের সামনে গুরুর অপমান! সহ্য করা কঠিন। আলিম অন্য একটা মাউথপিসে বলেন, হ্যালো ওয়ান-টু-থ্রি-মাইক-টেস্টিং..সোদানির পোয়ারা তোদেরকে কিন্তু দিব ভরে ‘লিটল বয়’ এবং ‘ফ্যাট ম্যান’। চুপচাপ বইসা থাক। ওস্তাদ কী বলে ঝিম মাইরা শোন। একজন অবসরপ্রাপ্ত ড্রাগলর্ডের কাছে অপমানিত হয়ে মার্লে, লেনন এবং মরিসন নিজ নিজ আসনে বসে পড়েন। মার্লে একটা বড়সড় জয়েন্ট ধরিয়ে কষে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে অন্য দুইজনের হাতে গাঞ্জা তুলে দেন। অন্য দুইজনও কষে টান দিয়ে একটু ঝিম ধরেন। সাথে কিছুটা হুইস্কি অন দ্যা রকসে তিনজনই গলা ভেজান।

সবাই যখন চুপ। হিটলার আবার বক্তব্য শুরু করার আগেই আন্না ফ্রাঙ্ক উঠে দাঁড়ান। আন্না কাতরসুরে বলেন, আপনি কি কোনোদিনই ম্যাচিউর হবেন না? যুদ্ধ ছাড়া কি আপনি কিছুই ভাবতে পারেন না? যুদ্ধ মানবসভ্যতাকে পঙ্গু করে ফেলে এই সহজ কথাটা বোঝেন না কেন?

হিটলার হাত উঁচিয়ে আন্নাকে থামতে বলেন। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধানই ভানে। স্বভাব পরিবর্তন করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। আর আত্মপক্ষ সমর্থন হচ্ছে যে-কোনো অস্তিত্বেরই মুদ্রাদোষ। সাধু-বুদ্ধিই হোক আর অসাধুই হোক, আত্মপক্ষ সমর্থন সে করবেই। এ যেন প্রাকৃতিক মুদ্রাদোষ। হিটলারও সেই মুদ্রাদোষেই কথা শুরু করেন। বলেন, আপনি ভুল বলছেন। এইখানে আমার ক্ষমতার প্রদর্শন আমি করতে চাই না। তা না হলে আপনি আমাকে এই কথা বলবার সাহসই পেতেন না। আপনারা আমাকে যতটা খারাপ ভাবেন ততটা খারাপ আমি নই। আমার থেকেও খারাপ মানুষের অস্তিত্ব ইতিহাসে আছে।   যাই হোক। যুদ্ধ আসলে নিত্য। যুদ্ধই সত্য। নিরন্তর যুদ্ধের পথে চলাই আমাদের নিয়তি। যুদ্ধই বিপ্লব। যুদ্ধ ছাড়া বিপ্লব আসে না। আর বিপ্লব ছাড়া মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নাই। মানুষ অতীতে যুদ্ধ করেছে, বর্তমানে করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। যুদ্ধই একমাত্র ব্যবসা যা দুনিয়ার সকল মহলে স্বীকৃত। যদি যুদ্ধ না থাকে তবে মানুষের মাঝে মৃত্যুর ভয় থাকবে না। আর মৃত্যুর ভয় না থাকলে বিজ্ঞানীরা নতুন আবিষ্কারে মনোনিবেশ করবে না। আইনস্টাইন সাহেবকে সবচেয়ে বেশি ধন্যবাদ আমার পক্ষ থেকে। তিনিই পৃথিবীকে মাইক্রোম্যাকানিক্সের পথ দেখিয়েছেন। সেই পথেই এখন পৃথিবী মানুষের পকেটে ঢুকে গেছে। এবং যুদ্ধ হয়ে উঠেছে অনিবার্য।

হিটলার যখন এই কথাগুলো বলছিলেন, তখন আইনস্টাইন সমাবেশের এক কোণে রবিঠাকুরকে নিজের মনের কথাটা শেয়ার করছিলেন। আজ তিনি স্টেজে একটু ভায়োলিন বাজাতে চান। ব্যাস! এই টুকু কথাই। রবিঠাকুরও তাঁকে উৎসাহ জোগাচ্ছিলেন। এছাড়া তাঁদেরই আশেপাশে বসে থাকা অন্যান্য মনীষী ব্যক্তিরাও আইনস্টাইনকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। এমন সময়ই হিটলার আইনস্টাইনের কথা বলেন। আর আইনস্টাইনসহ সকলেই চুপ হয়ে যান। রবিঠাকুর বুঝতে পারেন, আইনস্টাইন হয়তো আজকেও ভায়োলিন বাজানোর চিন্তা বাদ দিয়ে দেবেন।

এমন সময় এরিস্টটল সাহেব চিৎকার করে বলেন, এই শুওরের বাচ্চা চুপ কর। কেউ এই গাধার বাচ্চাকে স্টেজ থেকে নামাও। আমার সব নেশা এই ব্যাটা মাটি করে দিচ্ছে। মার্ক্স বলেন, সহমত জানাচ্ছি। এই মাথামোটা লোকটা স্টেজে দাঁড়িয়ে কেবল যুদ্ধের বিজ্ঞাপন করে যাচ্ছে। সে কি আমার শ্রমিক ভাই-বোনদের কথা একবারও বলেছে? মেহনতি ভাই-বোনদের স্বপ্নের এবং বাস্তবতার কথা? বলেনি। ওকে ঐ গদি থেকে হটিয়ে দাও। তা-নাহলে বিপ্লবের মাকে এই হিটলার নিশ্চিত কলুষিত করে ছাড়বে।

হিটলার এইসব কোনো কথারই পাত্তা দিলেন না। তিনি আবারও বিয়ারে হালকা চুমুক দিয়ে পাগলের মতো একটু হাসলেন। হাসির কারণে ঠোঁটের কোণা দিয়ে একটু বিয়ার গড়িয়ে পড়লো। তিনি হাত দিয়ে মুখটা মুছে বলেন, পৃথিবীতে যতবার যুদ্ধ লেগেছে ততবার পৃথিবী নতুন করে নিজেকে উপলব্ধি করেছে। পৃথিবীর প্রজ্ঞা বেড়েছে। যুদ্ধই কেবল পৃথিবীকে শান্তির স্বপ্ন দেখাতে পারে। যুদ্ধই কেবল ধনী এবং গরিবকে একই ময়দানে এনে দাঁড় করাতে পারে। আপনারা সকলেই বিজ্ঞ ব্যক্তি। একটু ভালো করে চিন্তা করে দেখুন।

এই সময় আব্রাহাম লিংকন সাহেব উঠে দাঁড়ান। লিংকনকে স্টেজে আসতে দেখে হিটলার খুশি হন। তিনি লিংকন সাহেবের স্টেজে উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। এ-সময় সমাবেশের প্রায় সবাই চুপ। হিটলার ভাবেন, যাক এতক্ষণে লিংকনের বুদ্ধি খুলেছে। লিংকন তাহলে অবশেষে সকলের সামনে হিটলারের যুদ্ধ বিষয়ক দর্শনকে সহমত জানাবেন। যদিও হিটলার জানেন, সর্বসম্মুখে না হলেও যুদ্ধকেই মানবমুক্তির সোপান বলে লিংকন বিশ্বাস করেন। তো লিংকন সাহেব স্টেজে উঠে হিটলারের হাত থেকে মাউথপিসটা নেন। তারপর বলেন, দুঃখিত। আপনারা ইতিমধ্যে যুদ্ধ বিষয়ে অনেক কথা শুনেছেন। হিটলার তার নিজের দর্শন উপস্থাপন করেছেন। আপনারা জানেন, দর্শন হচ্ছে পাবলিক প্রোপার্টি। অফ দ্যা পিপল, বাই দ্যা পিপল, ফর দ্যা পিপল। হিটলারের মতামতের প্রতি ভোট করে আপনারা আপনাদের সংহতি জানাতে পারেন। এমনকি আপনারা ভোটিং পদ্ধতিতে হিটলারকে এই বারামখানা থেকে এক বছরের জন্য ব্যানও করে দিতে পারেন। বারামখানার মেনুস্ক্রিপ্টে এরকম পদ্ধতির কথা আছে। অবশ্য এক বছরের থেকে বেশি সময় আপনারা তাকে ব্যান করতে পারবেন না। নিয়ম নাই। তো বন্ধুগণ আপনারা কতজন হিটলারের পক্ষে আছেন? হাত তুলে হিটলারের সাথে সংহতি জানান। অবস্থা বেগতিক দেখে কেউই পক্ষে হাত তুললো না। কেবল হিটলার এবং আলিম এই দুইজনই হাত তুলে ভোট দিল। এরপর লিংকন সাহেব বললেন, তাহলে দেখা যাচ্ছে দুইটা ভোট হিটলার পেয়েছেন। কথার মাঝেই দেখা গেল আলিম স্টেজ থেকে নেমে গিয়ে কয়েকজন রিকশাওয়ালা এবং মেহনতি জনতাকে ধমকাচ্ছেন। হাত তুলে ভোট দেবার জন্য ভয়-ভীতি প্রদর্শন করছেন। কিন্তু মেহনতি জনতা কিছুতেই ভোট দিতে রাজি নয়। একজন হাতবিহীন ভিক্ষুক রেগে আলিমকে বললেন, যা শালা চামচ। হাত তুলুম না। কী করবি? মারবি? মার। মড়ার আবার মৃত্যুর ভয় থাকে নাকি?

এসব দেখে লিংকন সাহেব বললেন, আলিম তুমি জায়গায় ফিরে এসো। এইখানে এইসব করে তুমি ভোট পাবা না। এটা বাঙলাদেশ না। এইখানে ভয় দেখিয়ে কিংবা টাকা ঢেলে ভোট পাওয়া যায় না। আলিম ব্যর্থ হয়ে স্টেজে ফিরে এসে হিটলারকে বলেন, ওস্তাদ এগুলারে শিক্ষা দিতে হবে। বেয়াদ্দপ হয়া গেছে। আপনের আন্ডারগ্রাউন্ড বিজ্ঞানী টিমরে কাজে লাগাইতে হবে। হিটলার তখনও চুপ হয়ে থাকেন। এতটা অপমান! এটা তাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। সে ভাবেনি, লিংকন এভাবে বিশ্বাসঘাতক হবে। ভোট যেহেতু সিংহভাগই হিটলারের বিপক্ষে, তাই আগামী এক বছর হিটলার আর বারামখানায় আসতে পারবেন না। স্টেজ থেকে নামার আগে লিংকনের হাত থেকে মাউথপিসটা চাইলেন। বিদায় জানাতে। হিটলার এক ঢোক বিয়ার খেয়ে বললেন, চলে যাবার আগে আমি আবারো বলছি যুদ্ধই শান্তি। বিপ্লবই মুক্তি। আপনারা দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখেন। ইতিহাস ঘেঁটে দেখেন। যুদ্ধ ছাড়া বিপ্লব আসে নাই। মদ ছাড়া যেমন স্বপ্ন আসে না। তেমনি যুদ্ধ ছাড়া কখনোই শান্তি আসে নাই। আমি তো ভালা না। আপনারা ভালা নিয়াই থাইকেন। এরপর লিংকনের দিকে তাকিয়ে বলেন, এই তো রেখে গেলাম আপনাদের ভালার কাছে। আবার আসবো আমি। এসে দেখবো কতটা ভালো আছেন আপনারা! বক্তব্য শেষ করে হিটলার স্টেজ থেকে নেমে গেলেন। আলিমও গুরুর পিছে পিছে চলে গেলেন। লিংকন সাহেবও নিজের আসনে ফিরে গেলেন।

এই সময় আইনস্টাইন স্টেজে উঠে এলেন। বিনয়ের সাথে জানালেন, তিনি একটু ভায়োলিন বাজাতে চান। এবং ছোট্ট ভায়োলিনটা বাজাতে শুরু করলেন। আর সবাই রস খেয়ে মাতাল হয়ে উঠলো।

 

স্কেচ- স্নেহা দাস

Related posts