মদসংখ্যা- আমারে ডুবিয়ে দাও মদ ।। এলিসন চাকমা
জোছনার আলো ফুটেছে। দূরে ঝিঁঝি পোকারা ডেকে চলেছে অবিশ্রান্ত। চাঁদের আলো ঝোপঝাড়ের পাশে কলকলে বয়ে চলা ছোট্ট ঝিরির গায়ে লকলকিয়ে প্রতিফলিত হয়ে চারপাশকে কেমন যেন মোহাবিষ্ট করে তুলছে। তার সাথে আসন্ন শীতের ঠান্ডা হাওয়া, শিশিরে ভেজা মেঠো পথ- যেন এক মায়ালোকের সৃষ্টি করে চলেছে। গেয়ো পথ মাড়িয়ে অদূরের পাহাড়টার দিক এগিয়ে চলছে এক মাতাল। পা এক কদম আগায়, তো দেড় কদম পিছিয়ে যাবার মতো অবস্থা। ‘আজ পেটে একটু পড়েছে বেশী’- ভাবে সে। মাথা ভারী, চোখ দুটো বুঁদ হয়ে ঝিমিয়ে আসছে। এই অবস্থায় মাতাল না হয়ে থাকাটা যেন দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজের মধ্যে একটি। তবু পথ হাঁটছে মানিকচান। বাড়ি পৌঁছাতে হবে। না হলে বউ চিন্তায়-ক্লান্তিতে আর রাগে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। মাতাল হলেও এই সম্বিত টুকু যেন মানিকের জন্মগত পাওয়া।
গ্রামের ছোট্ট এক পাহাড়ের চূড়ায় মানিকের জুম ঘর। ছোট মাচাং ঘর। তাতে হ্লাউচিং আর মানিকের সুখের আবাস। তাদের যেন পাখির বাসা। খড়ের চালা- তার ফাঁক দিয়ে রাতবিরাইতে জোছনা উঁকি দিয়ে যায়। বাতাসের আনাগোনাও প্রচুর। মানিক মানুষের ঘরে বেগার খাটে আর বউ হ্লাউচিং ঘর সামলায়। ছোট্ট জুমে ধান, কলা, কুমড়ো এসব টুকিটাকি সবজির চাষ করে। হ্লাউচিং নারী হয়েও যেন জুমের কাজে দক্ষ এক মহিলা।
মোড়লের ঘরে ধানমাড়াই এর কাজ করেছে আজ মানিক। সারাদিন বেগানা খাটুনি হয়েছে সেখানে। তাই সন্ধ্যায় কাজ শেষ করে মোড়লের পুকুরে গোসলটা ছেড়ে যেই বাড়ির দিক রওনা দিবে সে- মোড়ল তাকে ডেকে হাফ বোতল মদ ধরিয়ে দেয়। বলে, ‘অ মানিক্যে সারাদিন ত খেটেছিস, এবার এইটাতে একটু গা গরম করে নে রে। রাতে খানা আর ঘুম ভালো হবে।’ হাতে নিয়ে এক চুমুক চেকে দেখে মানিক। দ চুয়ানি মদ। এ যে কড়া। ঘ্রাণটাও যে বুনো তার। মোড়লকে যেন সাক্ষাৎ ভগবানের দূত মনে হয় মানিকের। তো সেখান থেকে আসতে আসতে রাত নেমেছে। পাহাড়িয়া রাত। নীরব চারদিক। এইখানকার লোকেরা পালিত মোরগের সাথে সাথে যেন ঘুমিয়ে পড়ে আর ঘুম থেকে উঠেও খুব ভোরে। তারপর যে যার কাজে বেরোয়। তাই রাত নেমে আসতেই চুপচাপ সব। শুধু মাঝেমধ্যে দু একটা কুকুরের ডাক আর পাহাড়ের গায়ে ঝিঁঝিপোকাদের শব্দ।
গ্রামের পথ মাড়িয়ে মানিক এবার তাদের বাড়িমুখো টিলাপথ ধরে। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছাতেই বাড়িতে জ্বলা কুপিটা দেখা যায় এবার। মিট মিট করে জ্বলে চলেছে সেটা। মানিক গায়ের লুঙ্গিটা সামলিয়ে নেয় এবার। কোমরে হাত দিয়ে দেখে নেয় মদের বোতলটা আছে কি নাই। দেখে একটু আশ্বস্ত হয়। অল্প একটু মদ বেঁচে ছিল সেটা পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট হিসেবে খেয়ে গা গরম করে কাজে বেরোবে -এই আশায় সেটা কোমরে গুঁজে নিয়ে আসা। বাড়িতে ঢুকে দেখে- বউ হ্লাউচিং অগ্নিশর্মার মূর্তিতে তার দিক তাকিয়ে আছে।
-তোমার বাপদাদার রক্তটা আবার খেয়ে এসেছো আবার! প্রতিদিন কি না খেলেই নয়!
মানিক চুপ থেকে গোটা দিনের মাইনেটা বউয়ের হাতে তুলে দেয়। এবার একটু গা ঝারা হাসি দিয়ে বউয়ের দিক স্নেহ ছুঁড়ে দেয় সে। সে জানে হ্লাউচিং যতই কড়ার সুরে কথা শোনাক, তার রাগ বালির বাঁধ। কিছুক্ষণ পরেই সেরে যাবে সব। তাই মাতাল হলেও বাড়িতে এলে সব ঠিক যেন মানিকের। কিন্তু যতই স্থির-অনড় থাকার চেষ্টা সে করুক, বউর কাছে এলেই সব যেন বৃথা আয়োজন। দুজনে আজ একসাথে ঘর করছে প্রায় দুই যুগ। তাই বউ আগেভাগেই সব তেরো পেয়ে যায় আগাম অদৃশ্য এক আধিপত্যে। তারা কুপির আলোয় এবার খেতে বসে। হ্লাউচিং কলাপাতায় করে খাবার পরিবেশন করে। ভাত আর শাক সেদ্ধ, আর নাপ্পি দিয়ে কুমড়োর ঝোল। খাবারের পাতে মানিকের ঝিমানো দেখে বউ আবার ধমকায়- ‘লোকে দিলেই বেশি খেতে হবে কি তোমার ওই রক্ত!’ মানিক স্থির হয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে, পারেনা।
খাওয়া শেষ করে খাবার ঘরের পাশে ছোট্ট মাচাং এ শোয় তারা। কুপিটা নিভিয়ে দেয় হ্লাউচিং। মানিক শুয়েই নাক ডাকা শুরু করে। তাকে খোঁচা দিয়ে জাগায় হ্লাউচিং। বুকে শুয়ে রয় তার। মেয়েলি গল্প জুড়ে দেয়। তাদের দুই মেয়ের গল্প বলে। মানিক শুয়ে শুয়ে আধ ঘুম আধ জাগরণে শোনে।
তাদের দুই মেয়ে শেপালি ও তুলসী। পার্শ্ববর্তী এক গ্রামের স্কুলে পড়েছিল প্রাইমারি পর্যন্ত। পরে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। অভাবের সংসার। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই মায়ের মতো কাজে পটু হয়ে ওঠে তাদের এই দুই মেয়ে। দুজনের বয়সেও বেশী তফাত নয়। বছর তিনেকের ব্যবধান মাত্র। তারা মাকে ঘরকন্নার কাজে সাহায্য করে। তাদের জুম ঘরের নিচে উপত্যকায় বয়ে গেছে ছোট্ট এক ঝিরি। সেখান থেকে হাঁড়িতে ভরে কুয়োজল নিয়ে আসে শেপালি। ঘর মোছে। উঠোন ঝাড়ু দেয়। তুলসী রান্নার কাজে মা হ্লাউচিং কে সাহায্য করে। এইভাবে একটু বড় হয়ে কিশোরী পর্বে উত্তীর্ণ হলে তারা দুই বোনে শহরে পাড়ি জমায়। সেখানে গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। এখন সেখানেই থাকে দুই বোন। মাসের শেষের দিক কিছু হাত-বাজারের খরচ পাঠায় বাবা মায়ের জন্যে।
তাই রাতে স্বামীর বুকে শুয়ে শুয়ে গল্পজুড়ে মেয়েদের কথা তুলে হ্লাউচিং। মানিকচান শোনে আর ভাবে মেয়ে দুটোর বিয়ের বয়স হয়েছে। তাই তাদের ডেকে, উপযুক্ত পাত্র দেখে এবার বিয়ে দিতে পারলেই যেন বড় দায়িত্বটা ছাড়ে সে। ভেবে মুখে মদের গন্ধ নিয়ে ভারী নিঃশ্বাস ছাড়ে মানিক। হ্লাউচিং সহ্য করে নেয় সেটা। কম করে হলেও গত বিশটা বছর ধরে এ গন্ধ সহ্য করে করে পুষিয়ে নিয়েছে সে। মানিকের সাথে ভালোবাসায় জড়িয়ে পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিল সে। তাদের এই পাহাড়িয়া এলাকায় কয়েকটা ছোট ছোট গোত্রের মানুষের সমবেত বসবাস। তাদের সবার রয়েছে নিজস্ব ভাষা, আচার, ধর্ম। কেউ মূর্তি পুজো করে তো কেউ প্রকৃতির উপাসক-এইখানেই যা ভিন্নতা। মানিকচান ছিল অন্য গোত্রের। হ্লাউচিং এর গোত্রের লোকেরা প্রকৃতির পূজারি। সূর্য, চান, রোদ, বৃষ্টি এসবের পূজা করে। আর মানিকের গোত্র ছিল মূর্তির পূজারি- সনাতন। কিন্তু মানিক জোয়ান কাল থেকেই এই পূজাপার্বণ মানে না সে। সে বুঝে শরীরে-দিলে সব মানুষ এক। তার এই বেপরোয়া উচ্ছন্ন স্বভাবের কারণে হ্লাউচিং এর পরিবারের যত অমত। তা সত্ত্বেও হ্লাউচিং এর সাথে ঘর বাধে সে। গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে এই পাহাড়ের চূড়োয় এসে তারা ঘর বাঁধে।
দিনের সাথে পাল্লা দিয়ে রাত বাড়ে এবার। জুম ঘরের পাশে লাগানো কলাগাছের পাতায় হাওয়ারা দোল খায়। বাতাসের বেগ বাড়ে। শীতল সে হাওয়া। তারা সারাটাদিনের পর ক্লান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
পরদিন ভোরসকালে বেরোয় মানিক। আজ কার্বারি বাবুর ক্ষেতে কাজের ডাক পেয়েছে সে। গত রাতের বাঁচিয়ে রাখা মদটারে এক ঢোকে খেয়ে নেয় মানিক। কোমরে গতরাতের বেঁচে যাওয়া কিছু ভাত আর কুমড়ো তরকারির পটলা বেধে বেরিয়ে পড়ে সে। মদ যেন তার কাজে-কর্মে শক্তির আজন্ম এক উৎস। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে মানিক, মদ তার বাপ-দাদারাও খেয়ে এসেছে। কাজ করে এসেছে বেগার। জুমে, ক্ষেতে খাটুনি খেতে এসেছে। বনবাদাড় ঘুরে শিকার করে এসেছে। তখন ও সাথে ছিল এই মদের বোতল। তাই এই জীবনে সে এই মদ ছাড়ার কথা ভাবতেই পারেনা। গা এঁটে ওঠে। আর মদে শরীরে যেন বেগ পায় সে। খাটুনি খাটতে খারাপ লাগেনা তার। সূর্য ওঠার সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করে যায় মানিক। দুপুর গড়ায় মাঠে। খাবারের কথা ভুলে যায় সে। কার্বারি বাবু ক্ষেত দেখতে এসে হাঁকডাক দেয়,
-‘অ মানিক একটু জিরোবেনা কি? খাবারটা খেয়ে নাও বাপু।’ কার্বারি এসে কলাপাতায় মোড়ানো রান্না করা গরম গরম শুকরের মাংস এগিয়ে দিয়ে যায় একটু। সাথে পানিভর্তি মাটির পাত্র ‘হুট্টি’টি এগিয়ে ধরে তার দিক। বুনো শুকরের মাংস। এ যে মানিকের প্রিয় আমিষ। মানিক এবার পেটের খিদে বুঝতে পারে। হুট্টি’র পানি দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে সে। পেটের খিদে বুনো জিনিস। আদিম এক রুচি নিয়ে খাবারের পুরোটা সাবার করে ফেলে সে। কার্বারি এবার ডাবা (বাঁশের হুকো)-টা এগিয়ে দেয়।
– ল মানিক ডাবা টান। তোমার শেফালি আর তুলসী কাল বাড়ি আসছে। শহর থেকে গতকাল রামাই ফিরেছে। তার মারফতে খবরটা তোমাকে দিতে আসলাম।
-হ জ্যাঠা, সকালে রামাইর লগে দেখা হয়েছে।
-মেয়ে দুটো বিয়ের বয়স হয়েছে খেয়াল হয় কি মানিক? এবার পাত্র দেখে বিয়েটা দিয়ে ফেল ওদের।
-হ জ্যাঠা, ভালো গেরস্ত দেখে ওদের এবার বিয়েটা দিতে পারলেই বাঁচি। হুকোয় টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ার মুখে শুকনো হাসি লাগিয়ে কথাটা বলে ফেলে মানিক। মদ খেয়ে মাতাল-বেপরোয়া হলেও, কাজের বেলায় ঠিকঠাক সে। তার কাজের এই সততা- সারল্যের জন্যেই গ্রামের কার্বারি-মোড়ল তার খাটুনির প্রশংসা করে। তাকে কাজে নিতে ভালোবাসে।
সন্ধ্যা নামে। ক্ষেতের কাজ শেষ করে কার্বারিদের বাড়ির দিক উঠে আসে মানিকচান। কার্বারিদের বাড়ির দিকে রওনা দেয় সে। সেখানে নলকূপের হাতল টেনে পানি তুলে গোসলটা ছাড়ে। আর কার্বারি জেঠোর থেকে দিনের মাইনেটা নিয়ে বাড়ির পথ ধরে। গায়ের মেঠো সরু উঁচু নিচু টিলাপথ। কিছুটা দূরে দূরে গ্রামের ঘর গুলো। ফিরতি পথে গা শিরশিরে হাওয়া মানিকের শরীরে এসে লাগে। সর্ষে ফুলের মতো চাঁদ ঝুলে আছে মাথার উপর। বহমান হাওয়ার তোড়ে আসন্ন শীতের প্রকোপ বুঝতে পারে সে। বাড়ির পুরোনো চালটা আরেকটু ভালোভাবে মেরামত করে নেয়ার কথা ভাবতে ভাবতে সে মাঝপথে রিগেনদের বাড়ির দিক আগায়। বাড়ির উঠোনে গিয়ে শীতকাপা স্বরে নিচু গলায় ডাকে,
-রিগেন্যে মা! অ রিগেন্যে মা আছো নি বাড়িত?
কুপি জ্বালিয়ে রিগেনের মা রাঙাবি সাড়া দেয় সে ডাকে।
– অ মানিক্যে নি। আয় আয় বোস। কাঠের পিড়ি’টা (ছোট্ট বসার টুল) এগিয়ে দেয় তার দিক।
– না বসব না রিগেনের মা। দেরি হয়ে যাবে। আছে নি মদ?
রিগেনদের বাড়ি থেকে দশ টাকার এক গ্লাস মদ সে এক ধোঁকে গিলে খায়, সাথে একটু নুন খেয়ে এবার সোজার বাড়ির পথ ধরে।
তার ছোট্ট জুমঘরে বউ হ্লাউচিং ভাত রাঁধছে, লাউশাকের ডগাগুলোকে সেদ্ধ করার জন্যে ছিলিয়ে নিচ্ছে, মরিচ বাটছে। বাড়ি পৌঁছেই মেয়ে দুটোর আসার আগাম সংবাদটা জানাতে ভুলেনা মানিকচান।
পরদিন একটু দেরিতে ঘুম ভাঙে তার। কাজের তাগাদা নেই আজ। মেয়েরা আসছে তাই কোনো কাজ রাখেনি আজ সে। চুলোয় রাখা পোড়া কাঠের কয়লার গুঁড়ো দাঁতে ঘষতে ঘষতে মাচাঙের বাইরে এসে দেখে – বউ জুমক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করছে। পাতিলে রাখা জলে মুখটা কুলকুচে এবার সকালের ভাতটা খেয়ে নেয় সে। খাওয়া শেষ করে ডাবা’য় (বাঁশের হুক্কো) তামাক সাজায়, তামাক খায়। ডাবাটা অনেকক্ষণ ধরে -গরররর- শব্দে টেনে ধোঁয়া ছাড়ে। বুনো, তৃপ্তির সে ধোঁয়া। এরপর সেটা মাচাঙের একপাশে রাখে। এবার ঢুলো (বেতের হাঁড়ি)টা নিয়ে নিচের ঝিরিতে মাছ, কাঁকড়া, শামুক খুঁজতে যায় মানিক। আজ সাত সকালে মদ খাওয়ার তাগাদা অনুভব করে না সে। মেয়ে দুটো আসছে। আদিম খুশিতে ভরে উঠে তার মন। বেলা ওঠে। রান্নার আয়োজন চলে জুমের ছোট্ট ঘরটিতে। জুমঘরের বাইরে উঠোনে বসে হুঁক্কো টানছে মানিক। এমন সময় নিচের রাস্তার দিক তাকিয়ে দেখছে দূর থেকে কেউ আসছে তাদের দিক। লোকটি কাছে এলে দেখে -অরণু, মোড়লের রাখাল অরুণু। তখনো হাঁপাচ্ছে সে। মানিকের কাছে এসে জানিয়ে দিয়ে যায় – শহর থেকে আসার এক বাস মফস্বলি ঢোকার পথে তৈছাংটিলা পাহাড়ের মোড়ে এক্সিডেন্ট করেছে। ব্রেক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে পড়ে গেছে। তাতে একত্রিশ জন যাত্রী মারা গেছে। তার মধ্যে অজ্ঞাত কোন দুই বোন নাকি রয়েছে। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠে মানিকের। কলিজায় যেন কেউ লোহার গরম দণ্ডের স্পর্শ লাগিয়ে দেয় তার। আরো খবর এলো, লাশগুলোকে মফস্বলির সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে তারপর যার যার স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হবে। হ্লাউচিং কে এতসব না জানিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মানিক। গ্রামের কার্বারিকে নিয়ে ছুটে যায় মফস্বলি হাসপাতালের দিক । বুকে অজানা আশঙ্কা। দেবতার কাছে মনে মনে একটাই আকুতি- তার শেপালি-তুলসি যেখানেই থাকুক যেন সুরক্ষিত থাকে, ভালো থাকে। যে মানিকচান জীবনে কখনো কোন পূজা পার্বণে বিশ্বাসী ছিলনা সেই আজ মঙ্গল দেবতার কাছে প্রার্থনার আর্তি ছোঁড়ে, মদ না খাওয়ার মানত করে।
দুপুরের দিক মফস্বলির হাসপাতালে পৌঁছায় তারা। হাসপাতাল জায়গাটা এমনিতেই মানিকচানের তেমন একটা পছন্দের না। জীবনে তাকে কখনো এদিক আসতেও হয়নি। তার যাপিত জীবনের সাক্ষাৎ পাওয়া যাবতীয় সকল রোগব্যাধির নিরাময় সে গ্রামের কবিরাজ-বৈদ্যের কাছ থেকে পেয়েছে। জঙ্গলে কাজ করতে গিয়ে একবার কুঠারে পা মারাত্মকভাবে জখম হয়েছিল তার। পরিণামে গ্রামের এক কবিরাজের আশ্রয়ে বনের কিছু ভেষজজাতীয় লতাপাতার রসে মাসখানেকের মধ্যে সেরে ওঠে সে। হাসপাতালে পৌঁছালে শুনতে পায় তারা মৃত স্বজনের আহাজারি। বাইরে পুলিশের পাহারা আর লোকারণ্যের ভিড়। এত এত লোক মানিকচান আগে দেখলেও এই থমথমে পরিস্থিতি যেন তার কলজেটাকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। এখানে জীবন এমনিই। মৃত্যুতেই চেনা অচেনা সকলকেই কাছে পাওয়া যায়, প্রত্যক্ষগোচরে স্বজন হারানোদের কাউকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টার শেষটুকুও বাকী রাখেনা। কেউ একমাত্র আকুতি নিয়ে স্বজন খুঁজতে এসেছে, কেউ নিতে এসেছে স্বজনের লাশ। তাদের মধ্যে অজ্ঞাতসারে মানিকচান একজন। লাশেদের ভিড়ে অজ্ঞাত দুই বোনের লাশ যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে নিয়ে যাওয়া হল তাকে। মর্গে ঢুকে যেন পায়ে হাঁটার সব শক্তি হারিয়ে ফেলছে মানিক। লাশেদের ভিড়ে সেই দুটো লাশের কাপড়ে ঢাকা মুখ উল্টিয়ে দেখে মানিক। লাশ দুটো তারই আদরের শেফালি আর তুলসির। মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত দুজনই, তাই চেহারা ভালো মতো চেনা যাবার কথা যদিও নয় তবু নিজের মেয়ে, নিজের রক্ত- সে ঠিকি চিনে নেয়। সেখানেই ধপাস করে বসে পড়ে মানিক। তার গলায় কেউ চেপে ধরেছে যেন, আর্তনাদ করতে গিয়েও পারছেনা। চোখ দুটো তার শুকনো। জলে ভিজিয়ে নিতে গিয়েও পারছেনা। সর্বশক্তি দিয়ে নিজের দেহটাকে মর্গের বাইরে টেনে আনে সে। বাইরে বারান্দায় মোড়ল দাঁড়িয়ে পাশে।
-শক্ত হও মানিক। আমাদের শেফা আর তুলারে গ্রামে নিতে হবে। নেওয়ার খরচপাতির ব্যবস্থা আমি করছি।
সন্ধ্যায় গ্রামের শ্মশানে লাশ দুটোর যথা নিয়মে সৎকার করা হলো। মানিকচানের ছোট্ট জুম ঘর এখন পাড়ার মানুষে ভর্তি। গ্রামের পাড়া-পড়শিরা একে একে আসছে। সহায় সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে যাচ্ছে। হ্লাউচিংয়ের আর্তনাদে জুমের আকাশ ভরে যাচ্ছে। মানিক তখনও চুপ। বুক ভর্তি পাথর নিয়ে মাচাঙের উপর বসে আছে। পাশে কার্বারি -মোড়লসহ আরো গাঁয়ের অন্যান্য লোকজন বসে। চুপচাপ একের পর এক প্যাগ মেরেই চলেছে মানিক। এলাচ, একচুয়ানি, দচুয়ানি, ভাদিহাবা- কোনো মদই তার বুকের পাষাণ জমিনটারে ভিজাই দিতে পারছেনা আজ। এলাচের ঝাঁজ, দচুয়ানির কড়া স্বাদ কোনোটাতেই আজ তার পাষাণ বুকের দাবদাহ নিভছে না। একচুয়ানি কিংবা ভাদিহাবার বেতাল স্রোত ও সেই খরা দূর করতে পারছেনা। না না এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। মানুষ তো মরণশীল। পথে ঘাটে, অপঘাতে কত ভাবেই না মারা পরে মানুষ। কিন্তু তার শেফালি, তুলসির বেলায় কি সেটা কাম্য ছিল। হায়রে নিয়তি নির্ধারিত মানুষ রে। মানিকচান এবার হাসে। বিশাল অট্টহাস্যে জুম ঘর কেঁপে উঠে। সে হাসি এবার তার দু চোখের কোণ ছাপিয়ে জলের স্রোত বইয়ে দেয়। যাক, তারে ডুবায়ে দিতে পেরেছে মদ।