বেচারার বউ ।। ইউন হি কাইয়ুং
সে যে ডায়েরি লেখে তা আমার জানা ছিল না।
লেখালেখির ব্যাপারটা তাকে ঠিক মানায় না। যে বয়সে আত্মপ্রতিফলন কিংবা আত্মসমালোচনার মতো বিষয়গুলো ডায়েরি লেখার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করে সেই বয়সও তার নেই। স্কুলে থাকার সময় সে কোনো কিছু লেখার চেষ্টা করেছে বলেও আমি কখনো শুনিনি। এমনকি যে কয়টি প্রেমপত্র আমাকে লিখেছিল সেগুলোও ছিল গতানুগতিক মেয়েলি সেন্টিমেন্টের। সেগুলোতেও তার লেখালেখির প্রতিভার কোনো ছাপ ছিল না।
দিনের বেলায় আমি বাড়িতেই ছিলাম। আগের রাতে দেরি করে বাড়ি ফিরেছিলাম। ঘুমাতে অনেক দেরি হয়েছিল। দুপুর না গড়ানো পর্যন্ত ঘুমিয়েই ছিলাম। জেগে দেখলাম বাসায় কেউ নেই। সে হয়ত বাচ্চাদের নিয়ে মার্কেটে বা কোথাও গিয়েছে। পানি খাওয়ার জন্য বিছানা ছেড়ে উঠলাম। ড্রেসিং টেবিলের ওপর পড়ে থাকা নোটবুকটা চোখে পড়ল। ভেবেছিলাম, বাসার টুকটাক হিসাব রাখার খাতাটাতা হবে। কিন্তু না। সেটা ছিল ডায়েরি।
জুন ১৭
আমি সিঙ্গেল। চাকরি করি। সকাল ছয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত আমার কাজ। এরপর ফ্রি। এই সময়টায় আমি পড়ালেখা, গান শোনা- যা খুশি করতে পারি। শুধু বাইরে বের হতে পারি না।
এসব কী কথা? আমার স্ত্রী আবার কখন থেকে সিঙ্গেল হলো। বাড়িতে থেকে যে মহিলা দুটো বাচ্চা লালন-পালন করছে তার আবার কীসের চাকরি? এটা কি আর কারো ডায়েরি নাকি? না, ড্রেসিং টেবিলের ওপর অন্য কারো ডায়েরি থাকার তো কোনো উপায়ই নেই। হাতের লেখাই তো বলে দিচ্ছে, এটি তারই। সে তার নামের ‘ও’টা বড় করে এবং ‘ব’টা একটু প্যাঁচ দিয়ে লিখেছে।
কাজ না থাকলে আমি কারো সাথে দেখা করতে যেতে পারি। কারো সাথে অবশ্য আমার সুদৃঢ় কোনো সম্পর্ক নেই। কারো সাথে পাগলপাড়া কোনো প্রেমও নেই। যে কারণে আমার প্রতিদিন দেখা করতে যেতে হয় না। খুব বেশি হলে সপ্তাহে তিন কি চারবার।
কোনো কোনো সপ্তাহে অবশ্য আমার কোনো ডেটিংই থাকে না। যখন তেমন হয়, তখন আমি ভাবি, ঠিক আছে, বিশ বছর বয়সেও তো আমার প্রতিদিন ডেটিং থাকত না। তখন অবশ্য নিঃসঙ্গতা আমাকে কিছুটা কুঁকড়ে দেয়।
প্রথমে এই ডেটিংয়ের ব্যাপারটা আমাকে সন্দিহান করে তোলে। পরে আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারি। সে আমার কথাই উল্লেখ করেছে। সে যে খুব আবেগের জায়গা থেকে তা করেছে তেমন নয়। সে বোঝাতে চেয়েছে যে আমাদের দুজনের খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। কারণ, বেশির ভাগ সময় আমি বাড়িতেই থাকি না। ঠিকই বলেছে সে। আমি তার স্বামী। কিন্তু সম্ভবত ঠিকই, যদিও সে তার মতো করে খুব নিষ্ঠুরভাবে বলেছে কথাটা, আমাদের সুদৃঢ় কোনো সম্পর্ক নেই। বলতে গেলে সারাদিনই আমি মদ খাই। এমনও অনেক দিন যায় যে আমি বাড়িই ফিরি না। মধ্যরাতে কিংবা ভোরের দিকে বাড়ির ফেরার ব্যাপারটা যেহেতু নিয়মিত হয়ে গেছে তাই আমি আর তাতে খুব একটা গা-ও করি না। একবার সে আমাকে বলেছিল, আমি জীবনে কেবল দুটো কাজই করি- মদ খাওয়া কিংবা নিজেকে সংযত রাখা।
কিন্তু তার তো এসবই কমবেশি গা সওয়া হয়ে গেছে। আসলে আমি খুব একটা পারিবারিক লোক নই। এটাই হয়ত অসন্তোষের উৎস। আমি কখনো ভাবিনি যে এটা তার জীবনে এমন ভারী ছায়া ফেলবে। বিয়ের পরপর এ নিয়ে যে সে বিরক্ত হতো না তা নয়। এমনকি তখন সে বিয়ে-বিচ্ছেদের কথা বলেছিল। কিন্তু পরে সে সংসারের পুরো দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেয় এবং বাচ্চাদের লালন-পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন আর সে আমার কাছে এসব নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করত না। যতটা মনে পড়ে, গত বছর সে ঘোষণা দিয়েছিল, ‘তোমার সাথে থাকব না।’ মনে করেছিলাম লোকাল বাসে করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দোকানে যেতে যেতে কিংবা দোকান থেকে সস্তার জিনিসপত্র কিনতে কিনতে সে হয়ত পাড়ার মহিলাদের সাথে এ নিয়ে কোনো মজা করেছিল… কিন্তু আমার সাথে থাকবে না বলতে তাহলে কি এই বোঝাতে চেয়েছিল? নিজেকে সে বিধবা বা সিঙ্গেল মহিলা ভাবতে শুরু করল। মুখের ভেতরটা আমার বিস্বাদ হয়ে গেল।
আমার কাজ হচ্ছে দুই বাচ্চার দেখাশোনা করা এবং বাড়িতে চুলা জ্বালিয়ে রাখা। অবশ্যই তাদের একজন বাবা আছে। বাবা ছাড়া তো আর তাদের এই দুনিয়ায় আনা যায় না। কিন্তু পরিস্থিতি তাদের বাবার সাথে থাকার সুযোগ দেয়নি। আমি বাচ্চা দুটোকে ভালোবাসি। যদিও আমি বিবাহিত নই। তারপরও আমি মনে করি যে তারা আমারই। তাদের এত ভালোবাসি যে বাবার সাথে থাকার যে কী আনন্দ তা তাদের জানাতে ইচ্ছে করে। এই ইচ্ছা আমাকে ভীষণ কষ্টও দেয়। দুশ্চিন্তাও হয় আমার। তারা যদি বাবার কথা জানতে চায় তাহলে তাদের আমাকে বলতে হবে যে, তোমাদের বাবা তোমাদের সাথে নেই। এটা বলে তাদের অখুশি করতে হবে। কিন্তু কোনো কষ্ট ছাড়া তো আর জীবন হয় না। সেটা শুধু যে আমার ক্ষেত্রে তা তো নয়, তাদের ক্ষেত্রেও। এই ধরনের বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া না করাই ভালো।
আমার প্রেমিক যেদিন আসে না সেদিন আমি অপেক্ষায় থাকি আর চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ি। সে না এলে কেন এমন হয়? সে যদি আমার স্বামী হতো, সে বাড়ি না এলে আমার কষ্ট লাগত, কিন্তু সে যেহেতু কেবল আমার প্রেমিক, তাই আমার শুধু একটু খারাপ লাগাই থাকে। এটা কি নিশ্চিত নয় যে সে তেমন প্রেমিক নয় যে বিশ্বাসঘাতকতা করবে এবং আর কখনো আসবে না?
ওহ, তার লেখা কত নির্মম। সে উচ্চকিতভাবে সুস্পষ্ট করে কী বোঝাতে চেয়েছে তা আমি বুঝতে পেরেছি। সে যে অসুখী তাই সে বোঝাতে চেয়েছে।
আমি ডায়েরির পাতা উল্টাতে যাচ্ছিলাম। তখনই বাইরে থেকে দরজা খোলার শব্দ পেলাম। সে বাচ্চাদের একজনকে পিঠে নিয়ে ঢুকল। আরেকজনও তার কোলে ঝুলে আছে। তার হাতে প্লাস্টিকের বেশ কয়েকটি ব্যাগ। ‘তোমার ঘুম ভাঙল কখন?’
তার কণ্ঠে বেশ উষ্ণতা। কালো ব্যাগের ভেতর থেকে জুসের বোতলটি গলা বাড়িয়ে আছে। সে সম্ভবত এটি আমার জন্যই কিনে এনেছে। আমি একটু সংকোচের সঙ্গেই তার হাত থেকে প্লাস্টিকের ব্যাগটা নিলাম। তা করতে গিয়ে আমার অঙ্গভঙ্গি স্বাভাবিক ছিল না।
আগের রাতের অনুষ্ঠানে আমি যে বন্ধুদের সাথে ছিলাম তাকে তাদের কথা বললাম। সেটি ছিল শোকানুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটি ছিল আমার স্কুলের এক ক্লাসমেটের বাবার উদ্দেশে। আমার অনেক বন্ধুই সেখানে ছিল। সে তাদের প্রায় সবাইকেই চেনে। বিয়ের আগে আমরা বন্ধুরা যাই করতাম, যেখানেই যেতাম সেখানেই আমাদের গার্লফ্রেন্ডদের নিয়ে যেতাম। সেটা নাশপাতি বাগানই হোক আর বুখান পাহাড়ের কোনো টফু রেস্টুরেন্টই হোক। বুদ্ধের জন্মদিনে একবার আমরা হোয়াগাই মন্দির থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। সেই ঘটনাটা আমার মনে পড়ছে। আমার বন্ধুরা তখন আমাকে টিটকিরি মারছিল, ‘এই, তোর বাড়িই তো সবচেয়ে বেশি দূরে।’ তখন আমি হোয়াগাই মন্দিরের সামনেই থাকতাম। কিন্তু তার বাড়িতে যেতে হলে আমাকে চামশিলের পুরোটা পথ যেতে হবে। টিটকিরিটা তারা ঠিকই মারছিল। কারণ, তাকে পৌঁছে দিতে এবং ফিরে আসতে আমার অন্তত তিনটা ঘণ্টা গাড়ি চালাতে হবে।
‘তারা কেমন আছে? টং-গু কি বিয়ে করেছে? মিন-সকের নিশ্চয়ই বাচ্চাকাচ্চা হয়েছে, তাই না?’
বন্ধুদের কথা জানতে চাওয়ার সময় তার কণ্ঠে যেমন উচ্ছ্বাস থাকে তেমনই ছিল। বিয়ে করার পর আমি আর তাকে আমার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা বলি না। তাকে ছাড়াই বাইরে পান করতে যাওয়া ভালো। বাড়িতে মদ খাওয়ার কথা শুনতে শুনতে আমি প্রায় অসুস্থ হয়ে গেছি। সব সময় সে মদ খাওয়া বন্ধ করার জন্য ঘ্যানঘ্যান করে। আমি আমার আনন্দ নষ্ট করতে চাই না। ক্যাফে বা অন্য কোনো স্থানে তরুণী কোনো নারীকে নিয়ে আড্ডা মারা এমন কোনো বিষয় না। সে তা দেখলে একটা বিরাট ইস্যু করে ফেলবে। এমনকি সে আমার ইচ্ছাটাকে বাগে আনতে একটা যুদ্ধও বাধিয়ে দিতে পারে। আমিও যে তাকে কারণ দেখাতাম তা-ও নয়। বারবার অজুহাত দিতে দিতে আমারও মনে হতো যে আমি তাকে ঘরের ভিতর একেবারে কোণঠাসা করে ফেলেছি। আনন্দ ফুর্তি করার জন্য একা একাই বাইরে যেতাম আমি। জানি না সবকিছু কেন আজ আমাকে পেয়ে বসেছে। অর্থহীন ও অভিশপ্ত এই ডায়েরি।
আসলে গত রাতে আমি মোটেও খুব ভালো মেজাজে ছিলাম না।
জানি না কখন তা শুরু হয়েছিল। কবে থেকে এমন হচ্ছে জানি না, কিন্তু সম্প্রতি আমার আর গভীর বন্ধুত্বের সেই আবেগটা নেই। এমনকি হাইস্কুল জীবনের পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা হলেও সেই আবেগ বোধ করি না। স্কুলের পথে হাঁটা, আমাদের শিক্ষকেরা, জিমে কাটানো সময় এবং ঝগড়া-ফ্যাসাদের কথা মনে করতে আমার ভালো লাগে। কিন্তু যখনই আমরা আমাদের বর্তমান জীবনের কথা বলতে শুরু করি তখনই বাতাসটা বদলে যায়, প্রত্যেকেই ধূর্তামি দেখাতে থাকে, কে কার চেয়ে ওপরে তা প্রমাণ করার চেষ্টা করে, ক্ষমতাহীন বোধ করে এবং এ ধরনের আরো আরো ব্যাপার। গতকালও তেমনটাই হয়েছে। বিশেষ করে দুজন আস্ফালন শুরু করল। একজন রাতারাতি বড়লোক হয়েছে। বাপের কাছ থেকে পাওয়া একটা কুৎসিত পাহাড় পাথরের কোয়ারিতে পরিণত করেছে। আরেকজন লাইসেন্স করা ট্যাক্স অ্যাকাউন্টট্যান্টের অফিসের চেয়ার গরম করছে। সে বলছিল, কীভাবে সে তৃতীয় অ্যাপার্টমেন্টটি কিনেছে। আমার মতো যারা স্যালারি ম্যান তারা বাধ্য হয়ে মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে রেখে শুনছিলাম। কিন্তু আমাদের মুখের পেশিগুলো শক্ত হয়ে যাচ্ছিল। এটা কোনো ঈর্ষা নয়। তাদের আস্ফালন দেখতে দেখতে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলাম। স্কুলে থাকার সময় তারা পড়াশোনাই করত না। শিক্ষকরা তাদের সব সময় বকাবকি করত।
তারা কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা পেরিয়ে ভিতরে পর্যন্ত ঢুকতে পারেনি। আমরা যারা কলেজের জলপানি খেয়েছি তাদের সামনে তারাই এখন টাকার গরম দেখায়। আমি তা জানি, কিন্তু আমি এখনো কুঁচকে যাচ্ছি। পে চেক পাওয়ার জন্য আমরা যখন সারা মাস ঘাম ছুটাই। তারা তখন রিয়াল অ্যাস্টেট বা তেমন কোথাও বসে থেকেই আমাদের চেয়ে দশগুণ কামায়।
এসবই অত্যন্ত বাজে ব্যাপার। স্কুলে ভালো লেখাপড়া করা আর আদর্শ ছাত্র হয়ে উঠার মধ্যে গর্বের কিছু কি সত্যিই আছে? মানুষকে শ্রেণিবিভাগ করার ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো মাপকাঠি নয়। শিক্ষার্থীদের মান নির্ধারণে শিক্ষকদের যে প্রক্রিয়া সেখানেও গলদ ছিল। আমি বলতে চাচ্ছি, গণিত কিংবা ইংরেজি ভালো বলেই আপনি খারাপ ছাত্রদের চেয়ে বেশি সাফল্য পাবেন, তা হয় না। এই মনোভাবটাও এক ধরনের অবিচার।
আমাদের মধ্যে কেউ একজন বিদেশ চলে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুলল। হেই, আমি শুনেছি আমেরিকা ভালো নয়, তবে কানাডা নাকি বেশ। প্রতিদিন এইভাবে বেঁচে থাকার মানে কী আসলে? আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। বয়স আরো বেড়ে যাওয়ার আগেই আমাকে দেশ ছাড়তে হবে। তা যদি না হয়, তবে আমি গ্রামে চলে যাব, চাষবাস করব কিংবা তেমন কিছু একটা করব, প্রতিদিন সকালে উঠে অফিসে ছুটো, এই জীবন আমাকে একেবারে মেরে ফেলছে।
আরেকজন বলল, সে এরই মধ্যে বিদেশ যাওয়ার আবেদন করেছে এবং ইন্টারভিউও দিয়েছে। তারপর কিছুক্ষণ সে-ই আলোচনার মধ্যমণি হয়ে থাকল। স্ত্রীকে আমি তার সম্পর্কে বললাম।
‘এই, তাই উনের কথা তোমার মনে আছে?’
‘হ্যাঁ, আছে তো, তোমার হাইস্কুলের বন্ধুদের মধ্যে সেই তো প্রথম বিয়ে করল।’
‘সে জানাল, সে-ও নাকি দেশ ছেড়ে যাচ্ছে।’
‘কেন? সে তো ভালো চাকরি করে, সেটা ছেড়ে যাবে কেন?’
‘টিভির অনুষ্ঠান পরিচালকের কাজটা খুব চাপের, তুমি তো জানো। সে বলল যে সে সত্যিকারের মানুষের মতো বাঁচতে চায়। তাছাড়া তার মেয়েটা সবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। মেয়েটাও নাকি বিগড়ে গেছে। স্কুলে যেতে চাচ্ছে না। শিক্ষকরা নাকি কোনো কারণ ছাড়াই তাকে শাস্তি দেয়। কারণ হলো, অন্য বাবা-মায়ের মতো সে শিক্ষকদের আলাদা করে টাকা ঘুষ দেয় না। সে বলল, এই ঘটনার পর দেশের ব্যাপারে তার একেবারেই মন উঠে গেছে।’
স্ত্রী কিছুই বলল না। সে কি ঈর্ষান্বিত? কিন্তু ব্যাপার আসলে তা নয়। শাক-সবজি পরিষ্কারে সে এবার বেশ শক্তি খরচ করতে লাগল। বলল, ‘এই রকম সমস্যা কার না আছে? তোমার এটা ভালো লাগছে না, তাহলে এটা ছেড়ে দাও, নিজে কোনো ব্যবসা শুরু করো, নিজেই নিজের বস হয়ে যাও! যত কঠিনই হোক না কেন নিজের দেশ ছেড়ে যাওয়া উচিত না।’
আরে! সে কি বলছে? আমি ভেবেছিলাম অন্য বউদের মতো সেও বলবে, ‘ওদের জন্য ভালোই হয়েছে,’ কিংবা টক আঙ্গুর আর শিয়ালের গল্পের মতো প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলবে ‘বিদেশে থাকা খুব এতিমের মতো ব্যাপার, তাই না? এক-দুই বছরের জন্য হলে ঠিক আছে।’ কেন সে নিজের প্রতি এমন নির্দয় হয়ে উঠছে? কেন এমন অচেনা আচরণ করছে? কবে থেকে সে নিজের মতো মতামত দিতে শুরু করল? আমার একটু অবাক লাগছে। সে ঘরের কাজে আর বাচ্চাকাচ্চা পালনে খুব ভালো। এটুকুই আমি তার সম্পর্কে জানি। অবশ্য আমরা যখন ডেট করতাম, তখন আমরা মাঠের ঘাসের ওপর বসে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতাম আর সে চলতি ঘটনাগুলো নিয়ে ন্যায়-অন্যায় বিষয়ক ভাসা ভাসা কথা বলত। লনে দাঁড়ানো খাবারের গাড়ির দিকে সজু’র* গ্লাস ছুড়ে ফেলতে ফেলতে। এসবই তার মা হওয়ার আগের কথা। বিয়ের পর আমি তাকে বইয়ের পাতা উল্টাতে খুব একটা দেখিনি। আসলে অনেক দিন পর আমি তার সাথে এতটা সময় নিয়ে কথা বললাম।
‘তো আমি যদি তোমাকে জোর করি, তাহলে তুমি আমার সাথে বিদেশে যাবে না?’
সে এক ঝলক আমার দিকে তাকিয়ে দেখল। পালং শাক থেকে হাত সরিয়ে পেঁয়াজ পাতা পরিষ্কার করা শুরু করল।
‘আমি যেখানে জন্মেছি, সেখানেই থাকব বাকি জীবন। হয়ত অন্য কারো সাথে ডেট করব কিংবা অন্য কিছুর সাথে।’
‘মানে? অন্য কারো সাথে?’
কাজেই পরের দিন লুকিয়ে আর একবার তার ডায়েরি দেখা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না। ডায়েরির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাতা উল্টিয়ে গেলাম যতক্ষণ না অন্য কারো সাথে ডেট কথাটি চোখে না পড়ে। তারপর ঠিক সেখান থেকেই পড়া শুরু করলাম।
সেপ্টেম্বর ৪
আমি অন্য কারো সাথে ডেট করতে চাই। আমি কোনো পুরুষকে খুব সিরিয়াস চেহারা নিয়ে বলতে চাই, আমি তার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। তারপর মদ খেতে চাই। আমি কারো কাঙ্ক্ষিত হতে চাই। যে আমাকে শয্যাসঙ্গী বানাতে চায় তাকে নির্জনে বলতে চাই, আমাকে কতটা ভালোবাসে তা চোখের জলে বুঝিয়ে দিক। আমি চাই কেউ আমার জন্য উদ্বিগ্ন হোক। কেউ কখনো আমার আনুকূল্য পেতে চায়নি। এমনকি আমার জন্য কেউ ছটফটও করেনি কখনো।
আমি মূল্যহীন, ফালতু। আমি পরিত্যক্ত। সে কখনো-সখনো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে। মাঝেমাঝে আমার তাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে- স্ত্রীদের দিকে যদি তাকিয়েই না দেখবে তবে পুরুষেরা কেন সুন্দরী নারীদের বিয়ে করার জন্য এত কাঠখড় পোড়ায়? তাহলে কি আমি চেহারায় খোদাই করে স্ত্রী শব্দটা লিখে রাখব যাতে অন্যদের থেকে আমাকে আলাদা করে চেনা যায়?
হয়ত তার ভাণ্ডারে শব্দ খুব কম। না হলে কেন সে ‘পরিত্যক্ত’ শব্দটাই লিখল? সে এখনো আমার স্ত্রী। পরিত্যক্ত শব্দটা আমার হৃদয়ে ভারী হয়ে চেপে বসল। আমি না হয় একটু ব্যস্তই থাকি। আমাকে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়, কাজ করতে হয়, আনুগত্য-অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়। না হয় আমি একটু মদ খাই, মাঝে মাঝে বন্ধুদের আড্ডায় মুখ দেখাই, মাঝেসাঝে পানশালায় ঝাল স্যুপ খেতে খেতে একটু তাস খেলি। বোঝাতে চাইছি, এসবই তো বিষয়, তাই না?
যাই হোক, আমি নিশ্চিত, অন্য কারো সাথে ‘ডেট’ বলতে সে কি বুঝিয়েছে। বোঝাতে চায় যে সে আমার সাথে আরো বেশি সময় কাটাতে চায়। এটাই তার একান্ত চাওয়া আর এটা আমি যা ধারণা করেছিলাম তার চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন কিছু না। আমি কল্পনাও করতে পারি না সে অন্য কোনো পুরুষে আগ্রহী হবে। আমার এক জন্মদিনে সে এরকমই কিছু বলেছিল। সে বলেছিল, আজ তোমার জন্মদিন এবং আজ আমারও জন্মদিন, তুমি এই দিনে না জন্মালে আমার এই পৃথিবীতে জন্মানোর কোনো কারণ থাকত না।
আচ্ছা ধরলাম, সে অন্য কোনো পুরুষের সাথে প্রেম করতে চাচ্ছে। সেক্ষেত্রে একজন মধ্যবয়সী গৃহিণীর কী কী সুযোগ আছে? আর সত্যি কী তার সেরকম করার ক্ষমতা আছে… আমার স্ত্রীর অন্য কারো সাথে ডেট করার আগ্রহের কথা শুনেও আমার উদ্বিগ্ন না হওয়ার এটাও আর একটা কারণ।
আগস্ট ২৫
আমার পিঠ ব্যথা করছে। গত বছর সে ব্যবসার কাজে চলে গেল। কাজেই ঘর বদলানোর কাজগুলো করতে হলো। ঘরের সব বাক্সগুলো খুলতে হলো। বিছানা ঠেলে সরানোর সময় পিঠের ব্যথাটা শুরু হয়। আকুপাংচারের পর মনে হয়েছিল ভালো হয়ে গেছে, কিন্তু ক্লান্ত হলেই ব্যথাটা আবার ওঠে। গতকাল থেকে আবার শুরু হয়েছে। আজ সকালে সে দরজা দিয়ে বের হতে হতে বলল, শরীর ভালো লাগছে না, অফিসে যত কাজই থাক না কেন তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে রেস্ট নেবে। এই কারণে তার পছন্দের খাবার তৈরি করতে গিয়ে আরো ছোটাছুটি করতে হলো। পাঁচটায় কাজ শুরু করেছি আর নয়টা বাজার পরও শেষ করতে পারিনি। কারণ, মিন-ইয়ং তার কান্না বন্ধ করছিল না, এমনকি মিন-হুও আজকে নানা সমস্যা পাকিয়েছে।
যখনই মিন-ইয়ং কান্না করছিল তিলের বীজ পরিষ্কার করা কিংবা ডিমের খোসা ছাড়ানো বাদ দিয়ে তাকে কোলে নিতে হচ্ছিল। তারপরও সে থামছিল না। তাই তাকে রান্না ঘরে নিয়ে আসি আর কাটাবাছার কাজ করতে থাকি। কিন্তু সে কাটার তক্তার ওপর ভয়ংকরভাবে হাত দিচ্ছিল। দূরে সরিয়ে বসানোর পরও হামাগুড়ি দিয়ে এসে চেয়ারের ওপর পড়ে গেল আর তার পায়ের চামড়া ছুলে গেল। সে কাঁদছিল আর কাঁদছিল। ডিম আর দুধ খেতে দিয়েছিলাম। তা-ও ছুড়ে ফেলল। সেসব পরিষ্কার করে, হাত ধুয়ে আমি সিংকে ফিরলাম। গরম তেলে চিংড়িগুলো ছাড়ব, এই সময় মিন-হু বলল, সে হাগু করবে। তাকে টয়লেটে বসিয়ে দিয়ে রান্না ঘরে ছুটে এলাম। চুলার জ্বাল কমানোই ছিল, কিন্তু এর মধ্যেই গরম প্যান থেকে ধোঁয়া উঠা শুরু হয়েছে। তাড়াতাড়ি প্যানটা নামিয়ে ফেললাম। হাতে বোধহয় পানি ছিল। পানির ছিটা পড়ে আমার কব্জিতে গরম তেল ছিটকে এলো। সাথে সাথে ফোস্কা পড়ে গেল। হাতে তাড়াতাড়ি ভ্যাসলিন লাগিয়ে রান্নাঘরে ফিরে দেখি টেবিলে রাখা কৌটা থেকে ময়দা নিয়ে গায়ে মেখে মিন-ইয়ং সাদা হয়ে গেছে। ফোন বেজে উঠল। ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর জানাল, ফিরতে দেরি হবে। সে ফোন রেখে দেওয়ার পরও আমি রিসিভার ধরে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। গত কয়েক ঘণ্টা ধরে আমি এসব কি করছিলাম?
সে যখন আমাকে তার পিঠের ব্যথার কথা বলেছিল তখন আমি তাকে কী বলেছিলাম তা মনে করার চেষ্টা করলাম। ‘তুমি কি পাগল, বিছানা সরাতে গেছ একা একা?’ তারপর সে যদি বলত, ‘কী করব, তুমি তো বাসায় ছিলে না,’ তাহলে আমি হয়ত বলতাম, ‘তুমি সাহায্য করার জন্য কোনো লেবার নিতে পারতে।’ সে প্রতিবাদ করত, বলত, ‘ঘর গোছানোর জন্য এমন সীমিত বাজেটে মজুর নেবে কীভাবে?’ এই কথা শুনে হয়ত আমার বিরক্তি শুরু হতো এবং আমি বিষয় পরিবর্তনের জন্য বলতাম, ‘ভালো, ভালো, এরপর থেকে তুমিই সব হিসাব করো।’ সে হয়ত দীর্ঘশ্বাস ফেলত, ঠোঁট কামড়ে থাকত, তারপর সামলে নিত কোনো রকমে। যেকোনো স্বামী-স্ত্রীর এসবই তো দৈনন্দিন কথোপকথন।
আমি কি একজন খারাপ মানুষ? আমার তা মনে হয় না। আমি তো কখনো তাকে প্রতারণা করিনি এবং কখনো আমার বেতনের টাকা তার কাছে লুকিয়ে রাখিনি। এমন কোনো মানুষ আছে যে তার স্ত্রী আর সন্তানদের সম্পদ ভাবে না?
যারাই মদ খায় তারা জানে যে তারা মদ থেকে দূরে থাকতে পারবে না, কারণ তারা তাদের স্ত্রী আর সন্তানদের ঘৃণা করে আর তাদের বাসায় ফিরতে ভালো লাগে না। এসবই সে সবার থেকে ভালো জানে- এই তো সে লিখেছে।
আসলে আমি নিজস্ব স্বাধীনতায় এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে বাসার দৈনন্দিন জীবনে বন্দি থাকতে ভালো লাগে না। স্ত্রী প্রতিনিয়ত মিতব্যয়িতা, সংযম আর সংবেদনশীলতা দিয়ে ক্লান্ত করে ফেলে। বাচ্চারা এতটাই চমৎকার আর মূল্যবান সম্পদ যে তাদের নিয়ে ভয় হয়। আর পারিবারিক বিষয় আমার কাছে একটা বোঝা। কেননা দিন শেষে আমরা সবার মতোই সুখী হতে চাই। এটা তো স্বীকার করতেই হবে যে স্বাধীন জীবন যাপন আমাকে এই শুষ্ক পৃথিবীতে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে, নয়ত বহু আগেই সে শেষ হয়ে যেতাম।
এই মুহূর্তে স্ত্রী ঘুমাচ্ছে। ক্লান্তির ঘুম। তার নিঃশ্বাসে জ্বরের তপ্ত ঘ্রাণ। কিছু এলোমেলো চুল কপালে পড়ে আছে। হাত দিয়ে তার কপালের চুল সরিয়ে দিলাম। সাথে সাথেই তার চোখ খুলে গেল। সে আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাল এক মুহূর্তের জন্য। যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। তারপর চোখেমুখে এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি নিয়ে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করল- যেন বলছে, এটা অন্য কিছু নয়, এটা কেবল স্বপ্ন।
আগস্ট ২৯
আমি বলছি না তাকে প্রতিদিন তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। বাসায় তাড়াতাড়ি ফেরা মানে পরিবারের প্রতি ভক্তি- এও আমি বিশ্বাস করি না। আমার মনে হয়, যে মানুষদের নিজেদের জন্য ব্যয় করার মতো সময় নেই তারা খুব দ্রুত বাজে হয়ে যায়। ঠিক বদ্ধ জলার পানির মতো। তবু এই নিঃসঙ্গতা অসহনীয়, এমনকি আমার পক্ষেও।
আমি তাকে বিয়ে করেছিলাম, কারণ তাকে ভালোবাসতাম। কিন্তু ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হওয়ার সাথে সাথেই নিঃসঙ্গতা আমাকে গ্রাস করল। নিঃসঙ্গতা যেন অপেক্ষায় ছিল। যেন এটাই প্রকৃতির নিয়ম। অপূর্ণ ভালোবাসা হয়ত নিয়ে আসে সুন্দর মিষ্টি কিছু কষ্ট। পরিপূর্ণ ভালোবাসা তোমাকে এরকম গতানুগতিক কিছু দিনের মাঝে ফেলে রেখে চলে যাবে।
‘পরিপূর্ণ ভালোবাসার গতানুগতিক দিন।’ এই কথাটাই লিখেছিল সে। আসলেই ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে আমার অচেনা লাগছে। অনেক আগে যার প্রেমে পড়েছিলাম সে আর এই নারী যেন এক নয়। তার চেহারা শুষ্ক হয়ে গেছে, দাগ পড়ে গেছে মুখে, নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ। আমি তার হাত ধরে আস্তে আস্তে চাপড় দিলাম। গতরাতে সে কি কিমচির* জন্য সব্জি কেটেছিল? নখের নিচে লাল মরিচের চোকলা ঢুকে আছে।
তিন-চারজন প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে প্রতিযোগিতা করে আমি তাকে জিতে নিয়েছিলাম। সততা আর আমার যুদ্ধ দেখে সে আমাকে পছন্দ করেছিল। একটা গোটা সেমিস্টার আমি প্রায় কিছুই করিনি তার পিছে পিছে ঘোরা ছাড়া। আমি তার ক্লাসরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ক্লাসের লেকচার শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতাম। তারপর তার দুপুরের খাবারের সময় তার সাথে সাথে থাকতাম। সকাল সকাল উঠে পড়তাম লাইব্রেরিতে তার জন্য জায়গা রাখতে। তার রিপোর্ট লেখায় সহায়তা করতে আশেপাশের স্কুল লাইব্রেরিগুলো চষে ফেলতাম।
এমন কি চুল পার্ম করতে সে বিউটি সেলুনে গেলেও আমি সেখানে বসে ম্যাগাজিন পড়তাম আর অপেক্ষা করতাম। তারপর আমার বন্ধুরা আমাকে সতর্ক করেছিল, আমাকে নিরাশ হতে হবে। আমি বিষাদের নায়কের কথা মনে করে বলেছিলাম, শুধু সাহসীরাই সুন্দরীদের জিতে নিতে পারে। এর কয়েক মাস পর সে সাড়া দিয়েছিল। ভেবেছিল আমি সারাজীবন এমনই থাকব এবং আমাকে বিয়ে করেছিল।
ঘুমের মধ্যে সে কেঁপে উঠল। যে টেবিলে বসে আমি তার ডায়েরি পড়ছিলাম সেটির লাইটের আলো বোধহয় তার চোখে লাগছে। একহাত ওপরে তুলে জামার হাতা দিয়ে চোখ ঢাকল। জামার হাতার প্রান্তটি ব্যবহারে বিবর্ণ হয়ে গেছে। আমি তার কাছে আমার মুখ নিলাম। তার কাঁধে আমাদের ছেলের বমির টক গন্ধ। হঠাৎ করে আমার এই সকরুণ ভালোবাসাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হলো। টান দিয়ে তার পায়জামা খুলে ফেললাম। সে তার চোখ খুলল। ঠিক এভাবেই আমি তার ভিতরে প্রবেশ করলাম।
সেদিন সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরলাম। তাকে দেখে মনে হলো খুশি হয়েছে। আর তার প্রথম কথাই ছিল, ‘কি গো তুমি আজ মদ খেতে যাওনি?’ ‘হ্যাঁ, তাই।’ কপট রাগের সাথে আমি উত্তর দিলাম আর তার হাতে আমার কোটটা খুলে দিলাম। যদিও সত্যি সত্যি আমার কোনো রাগ বা বিষাদ ছিল না। তার প্রফুল্লতা আমাকে অন্য কোনো অচেনা রাস্তায় নিয়ে যাচ্ছিল। সে খুব বকবক করছিল, বলছিল, কেন এখন কম খেতে হয় আর আমার তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসা চিন্তাও করেনি। আমার নিজেকে খুব অদ্ভুত মানুষ মনে হচ্ছে। কেন আমি এত অনুগ্রহ পাব আর ভাব ধরে থাকব। এমনকি আমি কিছুটা অহংকারী। আমি যেন কোনো জমিদারবাবু যে গরিব কৃষককে কয়েক বস্তা বার্লি ধার দিয়ে বারবার সাষ্টাঙ্গ প্রণাম আশা করছে।
রাতের খাবার শেষে আমি টিভি দেখতে বসলাম। সে প্লেট, গ্লাসগুলো ধুয়ে ফেলার জন্য রান্নাঘরে ছুটল।
ঠিক সে সময় ফোন বেজে উঠল।
‘আরে সমস্যা কি? হ্যাঁ, আমি আজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছি। এটা হতেই পারে, আরে বাবা আমার তো পরিবার আছে নাকি?’
ফোন করেছিল আমার এক বন্ধু। সে রাস্তার ওপারের একটা অ্যাপার্টমেন্ট থাকে। অন্য একটা শহরের কলেজে পড়ায়। একা একাই থাকে। মাঝে মাঝে সিউলে আসে। এলেই সে আমাকে ফোন করে। থালাবাসন ধুতে ধুতে সে উদ্বিগ্ন চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। এমনকি সে জলের কল আস্তে করে রেখেছিল যাতে আমি কি বলছি তা শোনা যায়। আমি যখন বললাম, ‘হ্যাঁ, আবার তোমার গেলাসের দেখা পেলে তো ভালোই হয়,’ তখন তার চেহারায় বিষণ্নতা দেখা দিল। আমি ফোন ছাড়লাম, ইচ্ছে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তারপর বললাম, ‘আমাকে যেতে হবে।’ যেন আমি নিরুপায়। আমি গায়ে কোট চাপিয়ে জুতা পরছিলাম। সে একটি কথাও বলল না। তার দিকে না তাকিয়েই বের হয়ে এলাম। বললাম, ‘তাড়াতাড়িই ফিরব।’ বাইরের বাতাসটা খুব সতেজ ছিল।
মদ খেয়ে মাতাল হয়ে আমি ঘরে ফিরলাম। বিছানায় গেলাম। মদের দোকানে আমরা কথার ঝড় তুলেছিলাম। তা-ও যখন যথেষ্ট মনে হলো না তখন বন্ধুটির বাসায় গিয়ে হুইস্কির বোতল খুলে বসেছিলাম… আমি খুব হিংসা নিয়ে বন্ধুটিকে বলেছিলাম, ‘এই শহরে থাকার চেয়ে গ্রামে থাকা খুব মজার, তাই না?’ বন্ধুটি বলেছিল, ‘এখনকার গ্রামের মানুষগুলো আর আগের মতো নেই, আশেপাশের শহরের উন্নয়নের জোরে তারাও এখন বাজে প্রকৃতির হয়ে যাচ্ছে। যখনই সিউলে আসি তখনই মনে হয়, এখানকার মানুষেরা আমার চেয়ে দশ বছর এগিয়ে আছে, আমি মনে হয় গেঁয়ো ভূত হয়ে যাচ্ছি।’
যাই হোক, এরকম চার-পাঁচ ঘণ্টা কথা বলার কারণে আমরা খুব পিপাসার্ত হয়ে পড়েছিলাম, কাজেই আমাদের মদ খাওয়াও চালিয়ে যেতে হচ্ছিল।
তিন-চারদিন পর, গলা শুকিয়ে যাওয়ার কারণে খুব সকালে আমার ঘুম ভাঙল। ফ্রিজ খুলে পানির বোতল বের করার সময় টেবিলের ওপর তার ডায়েরিটা চোখে পড়ল। টেবিলের লাইটটা জ্বালিয়ে ডায়েরিটা পড়া শুরু করলাম।
সেপ্টেম্বর ১৬
আমি এত সরল কেন? রাতের গভীরে সে আমার ভেতরে ঢোকার সময় তাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। কী আশ্চর্য! তখন আমার চোখে পানি চলে এসেছিল। জীবনকে কত তুচ্ছভাবে আমি দেখেছি। পরেরদিন সকালে সে খুব হালকা মুডে ছিল। বলেছিল তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসবে, সত্যি চলেও এসেছিল। আমার এত ভালো লাগছিল যে মাথা নিচু করে অভিবাদন জানিয়েছিলাম। যেন বলতে চাচ্ছিলাম, আমি তোমারই একান্ত নারী, আদর করো, জড়িয়ে ধরো- যা ইচ্ছা তাই করো। কিন্তু সে আবার বাইরে চলে গেল। আমি কেন একঘেয়ে? কেন আমি এত অযোগ্য তার কাছে?
যাই হোক রাত এগারটার পরেও সে বাসায় এলো না, কিন্তু এই সময় আমার কিছু সহ্য করতে ইচ্ছে করছিল না। রাগের থেকেও বেশি আমার অপমানবোধ হচ্ছিল। সত্যি সে তার স্ত্রীকে ভালোবাসে কি না সে প্রশ্ন এখন অবান্তর, কিন্তু মানুষের ন্যূনতম ভদ্রতা বলে তো একটা ব্যাপার আছে। আমি ভালো করে দেখলাম মিন-হু ঘুমিয়েছে কি না। তারপর মিন-ইয়ংকে কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে পিঠে ফিতা দিয়ে বেঁধে নিলাম। মিন-ইয়ং আমার রাগ বুঝতে পারছিল না, বরং আমার পিঠে চেপে খুশিতে পা নাচাচ্ছিল। আমি বাইরের সব খাবারের গাড়িগুলো ঘুরে দেখলাম। পুরো অ্যাপার্টমেন্ট এলাকা তন্নতন্ন করে খুঁজে আমি রাস্তার ওপারে গেলাম, কিন্তু সেখানেও সে ছিল না। মিন-ইয়ংকে পিঠে নিয়ে রাস্তার পাশের মদের ছাউনিতে যখন উঁকি দিলাম একজন ভদ্রলোক, সম্ভবত দোকানটির মালিক, আমাকে ভিতরে যেতে অনুরোধ করল। মনে হয়ে একটু দ্বিধান্বিত ছিল, কারণ বিবাহিত মেয়েরা এরকম জায়গায় উঁকি দেয় না। একজন ভদ্রমহিলা, সম্ভবত সেই লোকের স্ত্রী, তার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘তিনি বোধহয় কাউকে খুঁজছেন।’ যারা বসে মদ খাচ্ছিল সবাই ঘুরে আমার দিকে তাকাল। একজন মধ্যবয়সী লোক আমার দিকে টলোমলো পায়ে এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনি উঁকি দিয়ে কী দেখছেন? ঘাড় ধরে ওই ব্যাটাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যান। তার মুখের মদের গন্ধ ঝলকে এসে আমার নাকে লাগল।’
পিঠের ওপর মিন-ইয়ং মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। শরীর ভারী হয়ে ঝুলে আছে একদিকে। বেশ কয়েকবার আমি পিঠের ফিতা টাইট করে বেঁধে তাকে ঠিক করে নিলাম। সামনের দোকান থেকে আমি এক বোতল সজু কিনে নিলাম। একহাতে পিঠের ছেলেকে ঠেলে ধরে আছি যাতে পড়ে না যায়। আরেক হাত দিয়ে সজুর বোতল খুলে সরাসরি গলায় ঢেলে দিলাম আর বাসার পথে হাঁটা দিলাম। যদিও আমি পিঠে ছেলে নিয়ে রাস্তার এমাথা-ওমাথা হাঁটছি তারপরও আমার ক্লান্ত লাগছিল না। হয়ত মদের প্রভাবের কারণে। কিন্তু মদের এই প্রভাবও আমার অপমান কমাতে পারল না, আমি যে অবস্থায় ছিলাম, তেমনই রইলাম। আমার চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। সামনের এক অচেনা বাসার আলোকিত এক জানালার দিকে আমি তাকিয়ে রইলাম। কেন জানি না ওই আলোটুকুর উষ্ণতার জন্য আমার প্রাণ ব্যাকুল হয়ে রইল।
হঠাৎ আমার পেটে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম। কিছুক্ষণের জন্য শ্বাস নেওয়াও আমার জন্য কষ্টকর হয়ে গেল, যেন কেউ আমার বুকে ভোঁতা ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করেছে। কিছুক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিলাম, কিন্তু আমার মাথা এলোমেলো হয়ে আছে।
কখন থেকে আমার স্ত্রী মদ খাওয়া শুরু করল? সে তো অ্যালকোহল সহ্য করতে পারে না। আমাদের ডেট করার দিনগুলোতে তাকে টেনে মদের দোকানে নিয়ে যেতাম। এই একটা বিষয় ছাড়া সে তেমন কোনো অভিযোগ করত না। আমি জানতাম না সে একা একা মদ খায়। মদ বিষয়ক আর কোনো লেখা আছে কি না দেখার জন্য আমি তার ডায়েরির পাতা উল্টে গেলাম। আমার মন ভেঙে গেছে, আমার এরকম অনুভূতির আগামাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
এপ্রিল ৭
এক গ্লাস সজু ঢাললাম। প্রথম চুমুকে জিভে কড়া ঝাঁজ লাগল। আমার বুক কাঁপছে। মদ খাচ্ছি, এই বিষয়টাই আমার ভালো লাগছে- ভাত, রুটি কিংবা ফল খাওয়ার চেয়ে ভালো। প্রতিদিনের রুটিন জীবন থেকে বাঁচার এও এক উপায়, সম্ভবত সবচেয়ে সহজ উপায়। এমনকি তার সম্পর্কে আমার ভাবনাগুলোও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। অ্যালকোহল আমাকে বলছে- তুমি কারো স্ত্রী নও, বরং তুমি একজন নিঃসঙ্গ নারী, যে একলা একলা মদ খাচ্ছে।
মে ২৭
বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেলে আমি গোসল সেরে নিলাম। জানি না কত কত দিন পার হয়ে গেছে। আমি এতটাই ক্লান্ত যে নিজের কোনো যত্ন নেওয়ার সময় নেই। এমনকি আমার নিজের কাপড়চোপড় ভালো করে ধুতে কিংবা নিজের জন্য কিছু রান্না করতে আমার ভালো লাগে না। আমি নিজেকে এক কোনায় সরিয়ে রেখেছি। পরিবারের যত্নের কথা ভেবে ভেবে আমি নিজের যত্নের কথা একদিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছি।
আমার গোসলের পর, সিংকের সামনে কিছু সময় দাঁড়ালাম। আয়নার ভিতর দিয়ে নিজের নগ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আয়নার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছি। আমার স্তনের বোঁটা সিংকে লেগে আছে। শক্ত ও ঠাণ্ডা- পোর্সেলিনের ছোঁয়া আমার স্তনে যে অনুভূতি দিচ্ছে তা ভালো লাগছে। এই যে আমি এই ভালো লাগার অনুভূতি বুঝতে পারছি, নারী হিসেবে এও মনে হয় এক আনন্দের বিষয়।
কিন্তু বাথটাব পরিষ্কার করার সময় ভালো লাগার এই অনুভূতির সব চলে গেল। স্পঞ্জের ওপর ডিটারজেন্ট পাউডার ঢেলে বাথটাবের ময়লা জায়গাগুলো ঘষতে শুরু করলাম। এটা কি আমার সেই শরীর যা কিছুক্ষণ আগে ভালো লাগা অনুভব করছিল? আয়নায় এখন যে আমিকে দেখা যাচ্ছে তার মাথা বাথটাবের গভীরে, চুল এলোমেলো, আর সে জোরে জোরে ঘষছে টাবের ময়লা পড়া অংশ, তালে তালে তার পাছা উঠা-নামা করছে।
ঠিক এই সময় কলিংবেল বেজে উঠল। নিশ্চয়ই কোনো সেলসম্যান। ভাবলাম একটা বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করে সে হয়ত চলে যাবে, কিন্তু বেল বাজিয়েই চলল। সে তো দেখছি বাচ্চাদের ঘুম থেকে উঠিয়েই ছাড়বে। তাড়াতাড়ি গায়ের ওপর জামা চাপিয়ে দরজা খুলতে গেলাম। হ্যাঁ, সত্যিই সেলসম্যান।
‘ম্যাম, আপনি কি আমাদের প্রোগ্রামটা দেখেছেন?’
আমি ভাবছিলাম। দেখতে সে বেশ হ্যান্ডসাম।
‘আমি এটা নিয়ে এসেছি, আমাদের সকালের প্রোগ্রামে আপনি এটা দেখেননি? আমরা চাইছি এই দেশের নিম্ন মানের সংস্কৃতিকে বদলে ফেলতে।’
নিঃসন্দেহে বই বিক্রি করতে এসেছে। সে নিম্ন মান নিয়ে কথা বলে চলছে। আমার মতো মহিলা যারা ঘরে থাকে, কিন্তু কিছুতেই অজ্ঞ হতে চায় না বা দেখাতে চায় না- এ ধরনের বিজ্ঞ কথাবার্তা তাদের কাছে বই বিক্রির এক সস্তা ট্রিক। কিন্তু তার সাথে কথা বলতে আমার খারাপ লাগছে না। মনোযোগ দিয়ে তার কথা শোনার ভান করলাম। পুরো সময় তার চেহারার দিকে তাকিয়ে থেকে অবশ্যই। আন-সঙগিকে টিভিতে গলা-বন্ধ কালো সোয়েটার পরা দেখে যেমন বুকের ভেতর কেঁপে উঠেছিল, সেই অনুভূতির কথাই এখন মনে পড়ছে।
সে চলে যাওয়ার পর আবার বাথরুমে ফিরে এলাম। আবার বাথটাব ঘষা শুরু করলাম। দেয়াল আর টাবের কিনারা ঘেষে যে ছত্রাকের মতো ময়লা পড়েছে সেটা সহজে উঠছে না। গৃহ পরিচর্চা বিষয়ক টিপসের কথা মনে করার চেষ্টা করলাম। ‘কীভাবে ঘর পরিষ্কার রাখবেন’ বইয়ে কী লেখা আছে তা দেখতে বইটা তুলে নিতেই বইয়ের মধ্যে রাখা সব বিলের কাগজগুলো পড়ে গেল। আমি ভেবেছিলাম বাচ্চারা ঘুম থেকে উঠলে ওদের নিয়ে ব্যাংকে যাব।
‘এত সকালে লাইট জ্বালিয়ে কী করছ ওখানে?’
খোলা দরজা দিয়ে আমি আমার স্ত্রীর গলার আওয়াজ পেলাম। সে খুব মোলায়েম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল। তার এই নরম স্বরও আমার কানে ঝাঁজালো শোনাল। তাড়াতাড়ি তার ডায়েরি বন্ধ করে সেটা যেখানে ছিল রেখে শোয়ার ঘরে গেলাম। সে তখন গায়ে সোয়েটার চাপিয়ে রান্নাঘরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। কয়েকটি চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া ভাত তার সোয়েটারে লেগে শুকিয়ে গেছে। কেমন এলোমেলো।
ডায়েরি দেখে বউয়ের ওপর আমার মেজাজ খারাপ ছিল। কি জানি, হয়ত তাও নয়। আমি তো কখনো তার জন্য পাগল ছিলাম না। জীবন হতাশার মতো পার হয়ে যাচ্ছিল কেবল।
পরের দিন বন্ধুদের আড্ডায় মদ খেতে খেতে কথাবার্তা চলল।
‘ইদানিং নাকি হান নদীর তীরের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টগুলো চাহিদা হারাচ্ছে।’
‘সত্যিই, মজা করছি না, নিউজপেপারগুলো লিখছে, গৃহিণীরা নাকি হান নদীর দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে যায় আর তাদের মধ্যে বিষণ্নতা ও হতাশা বাড়ে, তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। কাজেই অনেকেই অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে দিচ্ছে।’
‘তারা সত্যিই ভাগ্যবতী। বিষণ্নতায় ভুগে কার মরার সময় আছে?’
‘স্বামীরা কাজ করতে করতে মরে যাচ্ছে, পরিবারের চাহিদা মেটাতে কত কিছু করতে হচ্ছে, অথচ তাদের স্ত্রীরা অবসরে বসে বিলাপ করছে আর জীবনের পাছায় লাথি মারছে।’ ‘খুব উঁচু মানের,’ আমি বলে রাখলাম। ‘জানো আমার বউ কী বলে? তার নাকি স্বাধীনতা দরকার। সে বলে ঘরের কাজ বিরক্তিকর আর কঠিন। অবশ্যই আমি তা মানছি। কিন্তু আমি যদি আমার কোম্পানির চাকরির সাথে তুলনা করি- সারাক্ষণ আমাদের গলায় দড়ি বাঁধা, পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য কত বিষ্ঠা যে আমাদের পরিষ্কার করতে হচ্ছে, সেই তুলনায় ঘরের কাজ তো কত্ত ভালো, তাই না?’
‘তো তুমি কি তাকে সেটা বলেছ?’
‘তোমার কি মনে হয় আমি মরতে চাই?’
এরপরের কথাবার্তা স্বভাবতই স্বামীদের সাহসিকতা বিষয়ক সস্তা কৌতুকে পরিণত হলো। তারপর কেউ একজন খুব জোরে হেসে উঠল সেসব নারীদের নিয়ে একটা কৌতুক বলে যারা অর্ধেক টাকা ব্যয় করে খাওয়ার পিছনে আর বাকি অর্ধেক ব্যয় করে ওজন কমানোর পিছনে। আমার সন্ধ্যা কেটে গেল গ্রিল করা পর্কের পাঁজর খোঁচাখুচি করে আর সজু গিলে, কিন্তু কোনোভাবেই মেজাজ ফুরফুরে হলো না।
বাসায় ফিরে তাকেও খুব ভালো মেজাজে দেখলাম না। সে দরজা খুলে দিয়ে নীরবে, শান্তভাবে আমার পিছনে দাঁড়াল। যেন সে তার কণ্ঠস্বর শোনানোর আভাস দিচ্ছে।
‘সমস্যা কী?’ আমার গলার স্বরেও কাঠিন্য ও বিরক্তি প্রকাশ পেল।
‘তুমি কি প্রতিদিন মদ খাবে?’
‘হ্যাঁ, আমি প্রতিদিন মদ খাব। মদ ছাড়া কেউ সামাজিক হতে পারে না। এটাই সত্যি, মদ ছাড়া আমি কখনোই সামাজিক হতে পারব না। একজন মানুষকে দেখাও তো যে মদ ছাড়া এবং একজন মানুষকে দেখাও যে লিভার ক্যানসার ছাড়া।’
আমি যখন ব্যাঙ্গ করে কথাগুলো বললাম, সে তার ঠোঁট কামড়ে ধরে ছিল। আমরা দুজনেই নীরব ছিলাম। আমার কেন জানি খারাপ লাগতে শুরু করল। কিন্তু মুখে কঠিন অভিব্যক্তি ধরে রাখলাম একটু আগের রাগের ভাব ঠিক রাখার জন্য। সে কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকল, নড়ল না। সে আমার দিকে তাকিয়েই আছে। যখন তার মাথা সামান্য ঘোরাল তখন দেখলাম, তার চোখে জল ছলছল করছে। তার বিড়বিড় করে বলা কথা আমার কানে পৌঁছল। ‘জীবনকে কি একটু সিরিয়াসভাবে নেওয়া যায় না? এভাবেই সারা জীবন নষ্ট করবে?’
সে কী বলছে এসব? হঠাৎ আমার কান অসাড় হয়ে গেল।
ওই ঘটনার পর কিছুদিন সে আর তেমন কোনো কথাই বলল না। রাতে বাসায় ফেরার পর কিংবা সকালে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আগের মতো সম্ভাষণও জানাচ্ছিল না। বেরিয়ে যাওয়ার সময় সে আর দরজার কাছে এসে দাঁড়াত না। এই প্রথম আমি একটু একা বোধ করতে লাগলাম। বুঝতে পারলাম বিগত বছরগুলোতে সে আমার প্রতি কত আন্তরিক ছিল। আমি আগে সাধারণত এমনটা বোধ করিনি। কিন্তু আমার প্রাত্যহিক জীবনে তাতে কোনো প্রভাব পড়ল না বা কোনো অস্বস্তিও দেখা দিল না। কাজের জায়গায়ই হোক, আর বাড়িতেই হোক, এটা ছিল আমার জন্য খুব সামান্য ব্যাপার। বাড়িতে থাকার সময়টায় এমনিতেই তার সাথে খুব বেশি কথা হতো না। যে কারণে অনশন ধর্মঘট কিংবা নীরব থেকে তাকে শাস্তি দেওয়ার মতো কোনো ব্যাপার ছিল না। যদিও পরিস্থিতিটা আমার জন্য বহন করছিল শক্তিশালী একটা ইঙ্গিত।
বরফ আমাকেই প্রথম গলাতে হলো। আমাদের ডেপুটি ম্যানেজার নির্দেশনা দিয়েছিলেন কোম্পানির কর্মচারীদের স্ত্রীদের ‘এনরিচমেন্ট কোর্স ফর কোম্পানি ওয়াইভস’ কর্মশালায় উপস্থিত থাকার জন্য। কর্মশালার লেকচারের শিরোনাম, ‘বুস্টিং ইয়োর হাজবেন্ডস স্পিরিটস’। লেকচারটি এক নারী সমাজকর্মীর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ‘এনডিয়ারিং ওয়াইভস ক্লাসেস’ নামের এই লেকচার দিচ্ছেন। কর্মশালায় আরো থাকবেন একটি ওম্যান ম্যাগাজিনের সভাপতি। উনার প্রিয় স্লোগান হচ্ছে ‘হাজবেন্ডস, লাভ ইয়োর ওয়াইভস’। আমার মনে হয়, ব্যক্তিগত জীবনে আপনি কী করবেন বা না করবেন সেসব বিষয়ে লেকচারের চেয়ে ফুল সংগ্রহ বা ক্যালিগ্রাফি অনেক ভালো। কর্মীদের জন্য কল্যাণমূলক কাজের অংশ এসব কর্মসূচি নিয়ে বিরক্তি দেখানোর মতো যথেষ্ট সাহসও আমার ছিল না। তারা এর আগের কোম্পানি স্ত্রীদের জন্য অনেক অনুষ্ঠান করেছিল। প্রতিবার আমি এড়িয়ে গেছি। কিন্তু এবার মনে হলো কথা প্রসঙ্গে লেকচারের কথাটা স্ত্রীকে বলে দেখি। ভেবেছিলাম সে হয়ত নতুন কিছু হতে পারে ভেবে বিষয়টা শুনবে। যাই হোক, আমি অবশ্য আশা করি না যে সে আমাকে নতুন করে উদ্বুদ্ধ করতে পারবে।
অবশেষে সেদিন সকালে কাজে বের হওয়ার সময় আমি বিষয়টা তুললাম।
‘ও, ভালো কথা, আমাদের অফিস অডিটোরিয়ামে কোম্পানি ওয়াইফদের জন্য একটা লেকচার আছে আজকে।’
‘…’
‘তুমি কি যাবে? দুইটার সময় হবে।’
‘কী বিষয়ে?’
‘বিষয় হচ্ছে বুস্টিং ইয়োর হাজবেন্ডস স্পিরিটস।’
সে আস্তে আস্তে তার মাথা তুলল এবং আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। স্বচ্ছ ও শূন্য দুই চোখ, যেন মাথার মধ্যে ন্যূনতম ভাবনাটুকুও নেই। যখন সে আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে ছিল, কোনো কারণ ছাড়াই আমার চেহারা লাল হয়ে যাচ্ছিল। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল কথাটা বলাই ঠিক হয়নি।
ঠিক সে সময় সে মুখ খুলল।
‘দেখি… বাচ্চাদের কারো কাছে রাখতে পারলে যাব।’
আমাকে দরজায় কিছুটা সময় দাঁড়াতে দেখে সে বলল, ‘মিন-হুকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে, ওর ঠাণ্ডা লেগেছে, কাজেই যাওয়াটা খুব কঠিন হবে…’
‘কে বলেছে তোমাকে যেতে হবে?’
বিস্ময়করভাবে আমার গলা দিয়ে রাগ বের হয়ে এলো। খুব ভালো হতো যদি সে অভিযোগ করত বা বিদ্রুপ করে কিছু বলত। তাহলে হয়ত আমার মেজাজ এত দ্রুত খারাপ হয়ে যেত না।
সেদিন রাতে স্বভাবই আমি মাঝরাতের পরে ফিরলাম। অনেকক্ষণ বেল বাজানোর পরও সে দরজা খুলল না। সে কি অসুস্থ? বাচ্চার যত্ন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল? অগত্যা, দরজার লকে চাবি ঢুকিয়ে দরজা খুললাম। ঘরে ঢুকে দেখি ডায়েরিটার ওপর মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত ছিল, কারণ ডায়েরির পাতায় তারিখ ছাড়া কিছুই লেখা হয়নি। কিন্তু ডায়েরির বাম পাশে আমার চোখ আটকে গেল।
মাঝে মাঝে মলত্যাগ করার পর আমার খুব অবাক লাগে। এই জঘন্য বিশ্রী জিনিস আমার শরীর থেকে বের হতে পারে, এটা আমার মেনে নিতে কষ্ট হয়। কিন্তু একে তো অস্বীকার করা যায় না। কে আর মলকে না বলতে পারে। কাজেই আমি খানিকক্ষণ এটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। অবাক হলাম। এটা আমার কাছে আর নোংরা মনে হলো না। মনে হলো, সেও পরিবারের এক সদস্য। সেও কঠিন এবং ধন্যবাদহীন কাজ করে যাচ্ছে। আমি কাছ থেকে ভালো করে পরীক্ষা করলাম। মন্দ নয়, আয়নায় দেখা ‘আমি’কে নিজের হাগু পরীক্ষা করতে দেখা।
ছেলে কান্না করে উঠল। আমি পাঁচ মিনিট ধরে বেল বাজানোর পরও যে সামান্যতম নড়েনি, বাচ্চার সামান্য শব্দেই সে জেগে গেল। দ্রুত দৌড়ে গেল ছেলের কাছে। মাথার ভেজা কাপড়টা বদলে দিল আর তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। চোখ দুটো তার এখনো ঘুমে জড়িয়ে আছে। ছেলের গালে গাল লাগিয়ে ধীরে ধীরে দোলা দিচ্ছিল আর পিঠে হালকা চাপড় দিচ্ছিল। ঘুম থেকে পুরোপুরি জাগতে পারেনি, তাই হাত ঠিকঠাক মতো পিঠে পড়ছিল না। ওষুধের প্যাকেট, থার্মোমিটার, জলপট্টি দেওয়ার বাটি, তোয়ালে- সবকিছু যেখানে সে বসেছিল সেখানে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে। এসব কিছুই বলে দেয় সে কয়েক ঘণ্টা ধরে একইভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানোর। বাচ্চাকে বুকে ধরে চোখ বন্ধ করে আছে, চেহারা ক্লান্তিতে বিবর্ণ। পিছনে টেনে বাঁধা চুল এলোমেলো হয়ে আছে, চুলের কাঁটা ঝুলে আছে একদিকে।
আমার হাতের ওপর খোলা অবস্থায় থাকা ডায়েরিটি আমি নীরবে বন্ধ করলাম।
জীবনযাপন- গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়। ট্রেতে রাখা আইস কিউবের মতো একেবারে জমে যদি বরফও হয়ে যায় তারপরও জীবন সমারোহময়।
ভাষান্তর : ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ
* সজু – কোরিয়ান মদ, কিমচি – বাঁধাকপির আচার