প্রবন্ধ বিশ্বসাহিত্য 

ম্যারাডোনা‌‌‍‌, সকার ইন সান এ্যান্ড শ্যাডো ।। এদুয়ার্দো গ্যালেয়ানো, ভাষান্তর- মঞ্জুরুল ইকরাম

যখনই খেলেছে তখনই জিতেছে। কেবল হেরে যাওয়া মূত্রত্যাগের কাছে!
তার শরীরে এফেড্রিন খুঁজে পাওয়া গেল আর নিমেষে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হল ১৯৯৪ বিশ্বকাপ ফুটবল থেকে। আমেরিকা সহ অনেক দেশের ক্রীড়া বিশেষজ্ঞরা এফেড্রিনকে শক্তিবর্ধক হিসেবে না দেখলেও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে এই জিনিসটা ছিলো নিষিদ্ধ।

বিস্ফোরণ ঘটলো দুনিয়ায়। হঠকারি আর কলঙ্কজনক সব শব্দ আর নিন্দার ঝড়ে বধির হয়ে গেলো যেন বিশ্ব। কিন্তু নিন্দিত নক্ষত্রের সমর্থনে তখনও কিভাবে যেন কিছু আওয়াজ উঠলো। ফিফার প্রতি অনাস্থা আর ম্যারাডোনার প্রত্যাবর্তনের দাবিতে শুধু আহত ও বাকরুদ্ধ বুয়েন্স আয়ার্সই না, কেঁপে উঠলো জগতের দূরতম স্থান বাংলাদেশের রাজপথও। তবে জাজ করা ও নিন্দা করা সবসময়ই সহজ। তবে সেরা হবার যে পাপটা ম্যারাডোনা করে গেছেন বছরের পর বছর তা ভুলে যাওয়া বেশ কঠিন। যেমন কঠিন, ক্ষমতাশালীরা যেসব কথার উচ্চারণে ভয় পায় সে কথাগুলোই উচ্চস্বরে বলে ম্যারাডোনা যে অন্যায় করেছে তা, ভুলে যাওয়াটাও। তাছাড়া বাম পায়ে খেলাটাও যেন তার বিশাল অপরাধ! খেলার যে ধরনটা অক্সফোর্ড ডিকশনারি মতে অর্থ শুধুই “বা হাত-পা সম্পর্কিত”ই না বরং যার মানে অশুভ ও সন্দেহজনক।
দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা কখনই ম্যাচের আগে শক্তিবর্ধক ড্রাগ নেয়নি। এটা সত্যি যে সে কোকেনে আসক্ত ছিলো। কিন্তু কখন নিতো কোকেন? যখন ম্যারাডোনাকে যেতে হতো বিষণ্ণ সব পার্টিতে আর তার মন চাইতো সেখান থেকে উধাও হয়ে এমন কোথাও চলে যেতে যেখানে সব ভুলে থাকা সহজ, আর কেউ তাকে চিনবেও না। কিন্তু সবার চোখ আর সবগুলো ফ্ল্যাশলাইটের ধাক্কা তাকে নিয়ে গেছিলো সেরাদের সেরার জন্য রাখা এমন এক বদ্ধ স্থানে যেখানে বাস করে ম্যারাডোনা অন্তত সুখী হতে পারছিলো না। এটা মনে রাখা তাই খুব জরুরী যে কোকেন নেয়ার কারনে না, কোকেন নেয়া সত্ত্বেও ফুটবলার ম্যারাডোনা ছিলো যে কারো চেয়ে সেরা।
নিজের ব্যক্তিত্বের ভারে সর্বক্ষণ মগ্ন থাকা লোক সে না হলেও তা অনুভব করতো সব সময়ই। সেই অনেক বছর আগে, প্রথম কোন ফ্যান যখন তার নামে চিৎকার করে প্রকাশ করেছিল উল্লাস; সেদিন থেকেই ম্যারাডোনার পিঠে ভার চেপেছে। ম্যারাডোনা নামের পাহাড়সম বোঝার ভারে বেঁকে যেতে লাগলো ব্যক্তি ম্যারাডোনার কাঁধ। শরীরের কথা শুধু রূপকার্থেই না, বাস্তবেই এমনটা ছিলো তার জন্য। ব্যথানাশক ছাড়া ঘুমাতে পারতো না পায়ের ব্যথার কারনে। ‘ফুটবল মাঠের ঈশ্বর’এর দায়িত্ব নিয়ে বেঁচে থাকা যে সম্ভব না তা বুঝতে বেশি দেরি হয়নি তার। কিন্তু প্রথম থেকে এও জানা ছিলো যে থেমে যাবার কোন্ সুযোগই আসলে নেই। অতিমানবীয় পারফর্মেন্সের অভূতপূর্ব চক্র শেষ করার অনেক পর; কর্টিজোন, বেদনানাশকের সাথে প্রশংসায় ফুলে উঠার সময়ের পর; ভক্ত পূজারীদের চাওয়ার কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হবার এবং হেটারদের বাক্যবাণে আহত হবার সেই দিনগুলোর ম্যালাদিন পরে অবশ্য স্বীকার করেছিলো যে মানুষের প্রত্যাশা আদতে তারও কাঙ্ক্ষিতই ছিলো।
কোন মহাকাব্যকে পুড়িয়ে ফেলার আনন্দ সরাসরি একটা মহাকাব্য রচনার তাগিদের সমানুপাতিক। স্পেনে এক ম্যাচে ম্যারাডোনার পায়ে যখন বলই ছিলো না সেই অবস্থায় গয়কয়চার পেছন থেকে করা আঘা্ত তাকে সাইডলাইনে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিলো কয়েক মাসের জন্য। সে অবস্থায় কিছু ফ্যানাটিক যেন তাদের কাঁধেই বহন করেছিলো এই পূর্বপরিকল্পিত খুনের অপরাধীকে। আর দুনিয়াজুড়ে কিছু মানুষ প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিলো ক্ষুধার রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে বিশ্বের রাজা বনে যাওয়া উদ্ধত অপাংক্তেয় এই অনুপ্রবেশকারীর পতন উদযাপন করার জন্য। ভদ্রবেশির দুনিয়ায় এবার পতন ঘটবে বদ ছেলেপুলের বাইক গ্যাং-এর ঝাঁকরা চুলের এমন এক বেয়াদব ছোকরার, যার ছিলো সত্য বলার দুঃসাহস।

এবার অনেক পরের ঘটনায় আসি, নেপলসে। ম্যারাডোনা ওখানে সান্তা ম্যারাডোনা। আর নেপলসের প্রধান সেইন্ট সান গেনারোকে স্থানীয়রা ম্যারাডোনার নামের আরমান্দোর সাথে মিলিয়ে ডাকছে সান গেনারমান্দো বলে। ম্যারাডোনাই তখন নেপলসের ঈশ্বর। নেপলসের রাস্তায় বিক্রি হচ্ছে এমন সব ছবি যেখানে ম্যারাডোনা যেন জেসাস! তার মাথায় আলোক বৃত্ত। অথবা লম্বা হুডি পরিহিত রহস্যময় কোন দেবতা, ঈশ্বরের প্রতি অর্ঘ্য নিবেদনে নিজ রক্ত ঝরান যিনি ছয় মাস পরপর। নর্দার্ন ইতালীর কুলীন ক্লাবগুলোর জন্য কফিনও বিক্রি করেছে তখন নেপলসবাসী। আর ছিলো ছোট্ট কিছু বোতল; সিল্ভিও বার্লুস্কোনির অশ্রু বিক্রি হতো স্বল্প মূল্যে। বাচ্চাদের তখন খুব প্রিয় ‘ম্যারাডোনা পরচুলা’। সেই সময়েই দান্তের ভাস্কর্যের পায়ের কাছে কে যেন রেখে গিয়েছিলো একটা ফুটবল। আর মাল্টার বিখ্যাত ট্রাইটন ফাউন্টেনকে পরিয়ে দেয়া হয়েছিল নাপোলীর নীল জার্সি।

সর্বশেষ কোন চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পর তখন কেটে গেছে প্রায় একটা শতাব্দী। ভিসুভিয়াসের আক্রোশ আর ফুটবল মাঠে শাশ্বত পরাজয়ের অনলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া নেপলবাসীরা তাই ম্যারাডোনার প্রতি নিবেদন করলো ঈশ্বরের ভক্তি। কারন এতোদিন পর ডিয়েগো ম্যাজিকেই অন্ধকার অনুন্নত দক্ষিণ ইতালির কাছে ফুটবল মাঠে রীতিমতো অপমানিত হলো উত্তরের শ্বেতাঙ্গরা। শুধু ইতালির স্টেডিয়ামেই না, ইউরোপজুড়ে নাপোলি জিততে থাকলো ম্যাচের পর ম্যাচ, কাপের পর কাপ। এবং নাপোলির প্রতিটি গোলে ঝরে পড়ছিল প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলা ও ইতিহাসের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের স্পর্ধা। মিলানবাসী ঘেন্না করা শুরু করলো ম্যারাডোনাকে। একমাত্র যে লোকের কারণে উদ্ধত চাষাদের সাথে মুখোমুখি লড়াইয়ে হারতে হয়েছে ন্যাক্কারজনকভাবে, তার জন্য রোষ ভিন্ন অন্যকিছু বরাদ্দ থাকার কথাও নয় অবশ্য। শুধুমাত্র মিলানেই না; ইতালিতে অনুষ্ঠিত হওয়া ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে দর্শকেরা ছিল ডিয়েগোর বিরুদ্ধে একদম মারমুখী অবস্থানে। ম্যারাডোনার পায়ে বল যেতেই শুরু হয়ে যেত কর্কশ হুইসেল আর ফাইনালে জার্মানির কাছে আর্জেন্টিনার পরাজয়ে তাদের উল্লাস দেখে মনে হয়েছে বিশ্বকাপটা জার্মানি না, ইতালিই পেয়েছে!
তারপর ম্যারাডোনা যখন নেপলস ছাড়তে চাইলেন, বেঁকে বসলো পুরো শহর। মোমের পুতুলে পিন ফুটিয়ে ম্যারাডোনার জানালায় ছুঁড়তে লাগলো অতি আবেগীরা। যে শহরের কয়েদীরাও ভালোবাসে ম্যারাডোনাকে আর কারাগার নিয়ন্ত্রণ করে নিয়াপলিটান মাফিয়া গ্রুপ ‘কামোরা’, সেখান থেকে বের হওয়ার প্রক্রিয়াও ঠিক সাধারণ ছিলোনা। ম্যারাডোনা তখন খেলে যেতে লাগলেন।হৃদয়ের বিরুদ্ধে; পা-ও যেন মানছিল না আর। এবং সেই সময়েই বের হলো কোকেইন স্ক্যান্ডাল। ম্যারাডোনা হুট করেই হয়ে গেলো ‘ম্যারাকোকা’; এমন এক অপরাধী যে মানুষকে বোকা বানিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছিলো যে সে একজন মহানায়ক।

                                                                                                               

এরপর বুয়েন্স আয়ার্সের মিডিয়া যেন আরো খড়গহস্ত হলো ম্যারাডোনার উপরঃ ডিয়েগোর ম্যাচের মতোই, তার গ্রেফতার হবার ঘটনাও সরাসরি সম্প্রচার করা হলো। রাজাকে সিংহাসনচ্যুত হতে দেখায় যারা পায় বিমলানন্দ তারা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে লাগলো ডিয়েগোর এই পুলিশের সঙ্গে চলে যাবার দৃশ্য। তারা বললো, “ও অসুস্থ“, “ও শেষ”।

 

দক্ষিণ ইতালীকে চিরন্তন অপমানের হাত থেকে রক্ষা করা মেসাইয়াহ আবার প্রতিশোধও নিয়েছিলেন ফকল্যান্ড যুদ্ধে আর্জেন্টিনার পরাজয়ের। সেই মিশনে শতভাগ চাতুর্যের আশ্রয়ে করা হ্যান্ড অব গড নামের গোলটার পরপরই স্টেডিয়ামে সৃষ্টি করলেন এক ঐশ্বরিক মুহুর্ত। প্রথমটা চুরি হলে এবার হলো মাস্তানি! অবাক বিস্ময়ে পৃথিবী দেখলো এভাবেও মাস্তানি করা যায়! ফুৎকারে পাতা উড়িয়ে দেয়ার মতো, ডিয়েগোর দৌড়ের তোড়ে পাতা হয়ে উড়ে যাচ্ছে সব ইংলিশ খেলোয়াড়! ব্যাখ্যাতীত সেই গোল অব সেঞ্চুরির কাছে ইংল্যান্ড কেবল ম্যাচই হারেনি বরং তার পরের কয়েক বছরের জন্য হারিয়ে ফেলেছিলো ফুটবল দেখার এতোদিনকার অভিজ্ঞতাকেও। কিন্তু মহানায়কের যখন পতন হলো, সে গিয়ে পড়লো এমনই গভীর খাদের তলদেশে যেখানে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া মৃত্যু পথযাত্রী কোন ঢ্যামনা মাগীও যায় না। ম্যারাডোনা হলো সেই বিশ্বাসঘাতক যে তার প্রতি শিশুদের ভালোবাসাকেও পায়ে মাড়িয়েছে। ম্যারাডোনাকে ছেড়ে গেল সবাই; যেন শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া একটা মৃত মানুষ।
সেই মৃত মানুষের দেহটা এক সময় উঠে বসলো। কোকেইন গ্রহণের সাজা শেষ হলো। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার আর্জেন্টাইন স্বপ্ন যখন পুড়ছে পৃথিবী কেন্দ্রের ভয়ানক উত্তাপে ম্যারাডোনা হলেন তখন এক আশ্চর্য অলৌকিক অগ্নিনির্বাপক কর্মী। ম্যারাডোনাকে ধন্যবাদ, তারা বিশ্বকাপে যেতে পেরেছিল। আর বিশ্বকাপ শুরু হয়ে গেলে, পুরনো দিনের মতোই, ম্যারাডোনা ছিলেন সেরাদের সেরা; এফেড্রিন স্ক্যান্ডাল যতক্ষণ না আঘাত হানলো।
ক্ষমতাযন্ত্র তাকে বাগে পাওয়ার জন্য সবসময়ই তক্কে তক্কে ছিলো। ডিয়েগো কথা বলতোই ক্ষমতাশালীর বিরুদ্ধে আর এবার সময় এলো তার খেসারত দেবার। সেটা সে নগদ অর্থে দিলো; কোন ধরনের ডিস্কাউন্ট ছাড়া। ম্যারাডোনা নিজেই সব ব্যাপার পরিষ্কার করতে চাইলো। তার অসংখ্য শত্রু আর আত্মহননের বাতিকের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য তার হাতে এ ছাড়া আর কোন অস্ত্র তখন ছিলো না। এর উপর আজীবনের শিশুসুল্ভ ভুলের ধারাবাহিকতায় পথে পেতে রাখা প্রতিটা ফাঁদেই নির্ভুলভাবে আটকা পড়েছে সে।
মাইক্রোফোন হাতে রিপোর্টাররা তাকে হয়রানি করলো। ঔদ্ধত্য, বদমেজাজ আর বেশি কথা বলার দায়ে তার নামে জানানো হলো সীমাহীন নিন্দা। রিপোর্টাররা ভুল ছিলো না। কিন্তু আদতে তাদের রাগের কারণও এসব ছিলো না। ম্যারাডোনার কিছু কথা এমনই ছিলো যে এর সামনে দাঁড়ানোই ছিলো দুষ্কর। ক্ষ্যাপাটে এই জাদুকরের অভ্যাসই ছিলো শব্দের ঘুষি ছোঁড়া। ’৮৬ আর ’৯৪ তে, মেক্সিকো আর যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বকাপে, ম্যারাডোনা চ্যালেঞ্জ করেছে টেলিভিশনের ভয়ংকর শক্তিশালী স্বৈরতন্ত্রকে, যে টেলিভিশন খেলোয়াড়দেরকে শরীর পুড়ে কয়লা ও রোস্ট হয়ে যাওয়া দুপুরের রোদে খেলতে বাধ্য করেছিল। ক্যারিয়ারের উত্থানপতনের সকল অধ্যায় জুড়ে এমন এক হাজার একটা ঘটনায় ম্যারাডোনা এমন সব কথা বলেছেন যা তার বিপদ ও শত্রুর সংখ্যা বাড়িয়েছেই বৈ কমায়নি একজনও। অবাধ্য ফুটবলার যে সে একাই ছিলো তা না; কিন্তু যে কন্ঠস্বরে কোন প্রশ্নের তীব্রতা বেড়ে যেতো বহুগুণ আর পরিষ্কার বার্তা পৌছে যেতো সবার কাছে, ওই কণ্ঠের অদ্বিতীয় মালিক ছিলো ডিয়েগো। শ্রম অধিকারের আন্তর্জাতিক মাপকাঠি কেন ফুটবলেও প্রয়োগ করা হচ্ছেনা? পারফর্মারদের শ্রমে কতো টাকা কামাই করা গেলো সেটা জানাই যদি সার্বজনীন চর্চা হয়ে থাকে তবে বহুজাতিক ফুটবলের পিতামাতাদের অঢেল ঐশ্বর্যের খতিয়ান কেন গতর খাঁটা ফুটবলাররা জানবে না?? হ্যাভেলাঞ্জ তখন বিবিধ ডিউটি পালনের ছলে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলো। আর ফিফার নামজাদা আমলা জোসেফ ব্ল্যাটার, যিনি জীবনে ফুটবলে একটা লাথিও মেরে দেখেননি, কেবল পঁচিশ ফুটি লিমুজিনের পেছনের সিটে বসে থাকেন চুপচাপ, তার বলার মতো একমাত্র কথাটি ছিলো, “আর্জেন্টিনার সর্বশেষ তারকার নাম ডি স্টেফানো।“

অবশেষে ম্যারাডোনাকে ছুঁড়ে ফেলা হলো ’৯৪ বিশ্বকাপ থেকে। ফুটবল হারালো তার সর্বকালের সবচেয়ে বলিষ্ঠ বিদ্রোহী ও ব্যাখ্যাতীত খেলোয়াড়কে। যখন কথা বলতো, ম্যারাডোনাকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন ছিলো। কিন্তু অসম্ভব ছিলো যখন তার পায়ে বল। বিস্ময়ের এই বরপুত্র নিছক খেয়ালের বশে, প্রতিপক্ষের হিসাবনিকাশ উল্টে দিতে কখন যে কোন শয়তানিটা করে বসবে তা ছিলো বাকীদের জন্য স্রেফ অকল্পনীয়। কারণ একই শয়তানি দুবার করার লোক ছিলেন না ডিয়েগো। চিতার মতো সাঁইসাঁই করে চলা গতি ছিলো না তার বরং বলা যেতে পায়ে খর্বাকার এক ষাঁড়; যে ফুটবলটাকে পায়ের সাথে সেলাই করে টেনে নিয়ে যেতো আর কাজে লাগাতো সারা শরীরে থাকা কয়েকশো চোখ। তার এ্যাক্রোবেটিক্সে নিমিষে উদ্ভাসিত হতো স্টেডিয়াম। গোলপোস্টের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়ানো অবস্থায় বিদ্যুতের ঝলকে সে ম্যাচ জিততে পারতো। শত্রু শিবিরের কয়েকশো পায়ের ভেতর দিয়ে বাড়াতে পারতো সম্পূর্ণ অবাস্তব পাস। গোলমুখের কাছাকাছি গিয়ে যদি ড্রিবল করার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলতো সেক্ষেত্রে তাকে আটকানোর চেয়ে তার খেলা দেখাই ছিলো উত্তম প্রস্তাব।

আজকের দুনিয়ার হিমশীতল ফুটবলে, যেখানে পরাজয়কে দেখা হয় ঘেন্নার দৃষ্টিতে আর সকল আনন্দের প্রতি বর্তায় নিষেধাজ্ঞা, এই মানুষটাই বোধহয় একমাত্র যিনি দেখিয়েছিলেন ফ্যান্টাসি দিয়েও দুনিয়া জয় করা যায়।

                                                                                                               (Eduardo Galeano, SOCCER IN SUN AND SHADOW)

Related posts