গদ্য বিশ্বসাহিত্য 

”ক্যাথে” – স্টিভেন মিলোসার – পর্ব ০১।। অনুবাদ- মাইশা তাবাসসুম

স্টিভেন মিলোসার। নিউইয়র্কে জন্ম গ্রহণ করেন। পেশায় ছিলেন শিক্ষক । একাধারে ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার। তার গল্প অবলম্বনে সিনেমাও বানানো হয়েছে। তার লেখা মূলত কল্পনাপ্রবণ। ‘এডউয়িন হাউজ’ নামক একটি বিখ্যাত উপন্যাসের জন্য তিনি পুলিটজার পুরস্কার পেয়েছেন।

যান্ত্রিক পাখি :

ম্পেরিয়াল প্যালেসের রাজসভায়  বারোটি গান গাওয়ার পাখি আছে, যাদের সমস্ত শরীর স্বর্ণ , কন্ঠস্বর রৌপ্য এবং চোখ স্বচ্ছ পান্না আর সবুজ জেড পাথর দিয়ে তৈরি । পাখিগুলো যে গাছে থাকে সেটি আসল নয়, তামার তৈরি। আর গাছের কান্ড ও শাখা-প্রশাখাগুলো অস্বচ্ছ সবুজ জেড পাথরে নির্মিত । এর সবটুকুই আবার প্রকৃত গাছ, পাতা, কান্ড ও বাকলের মতো করে রঙ করা । সেই গাছে বসা অবস্থায় পাখিগুলোকে শুধু সোনালী রঙের ঝিলিক কিঙবা জেড পাথরের ঝলকানির রুপেই দেখা যায়। যদিও তাদের সুমহান সঙ্গীত তাৎক্ষনিকভাবে রাজসভার প্রতিটি কর্নার থেকে, এমনকি দেয়ালের ওপাশের হল-ঘর থেকেও শোনা যায় । পাখিগুলো যে সারাক্ষন গাছের পাতায় বসে থাকে, তা নয় । বরং ঠিক বাস্তব পাখির মতোই তারা অবাস্তব গাছটির চারপাশে উড়ে বেড়ায়। কখনো বা কোনটি সম্রাটের কাঁধে বসে তাঁর কানের খুব কাছে গিয়ে সুরেলা ও বিষন্ন সঙ্গীত  শোনায় । জানা যায় যে, এই গানের সুর তাদের ভেতরে অবস্থিত একটা স্ফটিক স্বচ্ছ পিনে রেকর্ড করা, যদিও এর অভ্যন্তরিণ কার্যকারিতা সকলেরই অজানা । এই কলের পাখিগুলো প্রয়োজন অনুযায়ি গানের ধারার পুনরাবৃত্তি ঘটায়, কিন্তু তা এতই দক্ষতার সাথে ঘটানো হয় যে কেউ টেরই পায়না । আসলে কেউ যদি নির্মমভাবে যেকোন একটি পাখির গানের দিকেই শুধু মনোযোগ দেয় । একমাত্র তাহলেই বেশ কিছু সময় পর এই পৌনঃপুনিকতার খেলা বুঝতে পারবে । কিন্তু এত চালাকি আর দক্ষতার সাথে এক একটি পাখির গান সাজানো হয়েছে । যে কেউ শত চেষ্টায়ও যেকোন একটি পাখির গানে মনোযোগ রাখতে পারবে না । পাখিগুলোর আকার আকৃতি এবং গতি দেখে সবাই আসল পাখিই মনে করে। শুধু সোনার তৈরী বলেই তাদের আলাদা করা যায় । অনেকেরই বিশ্বাস, মানুষ আসল পাখির সাথে এদের যাতে  গুলিয়ে না ফেলে এর জন্যই এদের স্বর্ন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে । আবার এই পাখিগুলো নিজেদের যান্ত্রিক স্বভাব এমনভাবে লুকিয়ে ফেলে  ,লোকজন  বিস্মিত হইয়াও কূলকিনা পায়না ।

মেঘ :

ক্যাথের মেঘগুলো শুভ্রতার এক অস্বাভাবিক বিশুদ্ধতা ধারন করে, যেগুলোকে নীলকান্তমনির মতো আকাশের উপর স্পষ্টভাবে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় । হয়তো এর জন্য  সম্পূর্ণ স্পষ্টভাবে আমরা মেঘগুলোকে বিভিন্ন আকারে শ্রেণীভুক্ত করতে পারি । আসলে এখানকার আকাশে মেঘেরা কখনো এমন  আকার ধারন করে না, যা আমাদের অপরিচিত ।প্রতিটি মেঘকে এক একটি নাম ডাকা হয়; আর নামগুলো হয় সবসময়ই কোন বস্তুর নামে ।আর এসকল মেঘেরা দুনিয়াতে বিরাজমান  প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিম যে কোন বিশাল বস্তুর আকার  ধারন করতে পারে । এভাবে মেঘগুলোর নাম হয়ে ওঠে তরঙ্গ নাম্বার এক, তরঙ্গ নাম্বার ছয়শ বাষট্টি, কিংবা ড্রাগনের লেজ নাম্বার সাত, না হয় বাতাসে নোয়ানো গম নাম্বার পয়তাল্লিশ, অথবা ইম্পেরিয়াল জিন নাম্বার তেইশ । পরিচয়ে আমাদের আকাশের মেঘগুলো সদা-সর্বদা মহিমান্বিত এবং মর্যাদাপূর্ন আর  এই অনিশ্চয়তা ও দৃঢ়-দ্বিধার অভাব অন্যসব আকাশকে দুঃখি করে তোলে । আমাদের মেঘগুলোর এক একটি নির্দিষ্ট আকৃতির বাইরে বেনামি কিছুর আকৃতি ধারণ করা নিষিদ্ধ । ব্যাপারটা এরকম যে, এরা এক একটি তরল ভাস্কর্য, যা ধারাবাহিকভাবে কিছু নির্দিষ্ট আকৃতির অনুকরণ করে । কখনো যদি অজানা আকৃতি ধারনও করে তাহলে তা শীঘ্রই জানা কিছুতে পরিনত হয় যেন কেউ একজন একমুঠো মেঘ আকাশে টস করে দ্রুত তার অনুমানকে ধারন হতে দেখে । আর সেই অনুমানগুলো হয় ড্রাগন, বালিঘড়ি, রেকাব, প্রাসাদ কিংবা রাজহাঁস।

অনিদ্রার করিডোর :

” অনিদ্রার করিডোর” নামে আমাদের সম্রাটের দুটি করিডোর আছে । রাতে কখনো যদি তাঁঁর ঘুম না আসে, তখন তিনি সেই দুটি করিডোরের যেকোন একটিতে হেঁটে বেড়ান । করিডোর দুটি এতই লম্বা যে, ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত গতিতে ছুটে গেলেও একরাত্রি সময়ে সে কোনটিরই শেষ মাথায় পৌঁছুতে পারবে না। এদের মাঝখানে এক- একটি করিডোরের দেয়াল জেড পাথরে তৈরী । যা পলিশ করে প্রায় আয়নার মতো ঝকঝকে বানানো হয়েছে । এটার মেঝে, টকটকে লাল কার্পেট বিছানো; আর এটি অসংখ্য ঝাড় বাতির আলো দিয়ে আলোকিত করা । স্বর্ণের ব্যান্ড দ্বারা ল্লম্বভাবে বিভক্ত জেড পাথরের আয়নাগুলোতে সম্রাট নিজেকে সবুজের অসীমে তলিয়ে যেতে দেখেন, প্রকৃতপক্ষে যা আসলে সামান্য দূরের একটি বিন্দুতে গিয়ে মিলিত হয় । দ্বিতীয় করিডোরটি অন্ধকার, অমসৃণ ও ঘুরপাক খাওয়ানো । এটির দেয়ালগুলো গুহার মতো নকশা করা; আর এদের মাঝের দূরত্ব এত অনির্দিষ্ট যে, কোনো জায়গা দিয়ে সম্রাট, শত চেষ্টা করেও প্রবেশ করতে পারবে না, আবার কোন  কোন জায়গায় কিছু টর্চ বাতি এমনভাবে সেট করা দেখে মনে হবে থুতুর মতো আলো ছিটানো হয়েছে; এটির মেঝে মাটি ও পাথরের টুকরায় ভরপুর,  আবার কোথাও কোথাও ডোবার মতো খানা-খন্দও খুঁজে পাওয়া যায় ।

বালিঘড়ি :

বালিঘড়ি শিল্প ক্যাথেতে বেশ উচ্চ ও বিকশিত । সাদা ও লাল রঙের বালিঘড়ি নিম্নমানের হিসেবে বিবেচিত হয়, অন্যসব রঙের বালিঘড়িগুলো সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় । যদিও অনেকে তুষারজলের ও পারদের বালিঘড়ি পছন্দ করে তবে কাঁচের পাত্রগুলো বেশ ব্যায়-বহুল এবং অভিনব আকৃতির হয়; উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বানরাকৃতির বালিঘড়িগুলো যথাযথভাবে প্রখ্যাত ও সমাদৃত। সূক্ষ্ম প্রেমমূলক বালিঘড়িগুলো, কখনো বা ইষদচ্ছ রেশমি কাপড়ে আচ্ছাদিত, ক্যাথের প্রায় সব ভদ্রলোকের বাড়িতেই এগুলো দেখা যায় । আমাদের সম্রাটের একটা প্রবল আসক্তি আছে এসব বালিঘড়ির প্রতি । তাঁর ব্যাক্তিগত সংগ্রহের বাহিরেও ইম্পেরিয়াল প্যালেসের বিশাল পরিসরে অসংখ্য বালিঘড়ি আছে । এমনকি বাগান ও পার্কগুলোতেও । এত বালিঘড়ি রাখার কারন নাকি এই যে, এই জিনিসের প্রস্তুতকারক ও তাদের অসংখ্য সহকর্মীরা যেন এক নাগারে ব্যস্ত থাকে । বলা হয় যে, প্রাসাদের আকৃতিতে তৈরি একটা ক্ষুদ্র স্বর্নের বালিঘড়ি নাকি সম্রাটের পোশাকে সেলাই করা থাকে। বিশাল প্যালেসের অসংখ্য হলঘর, কক্ষ বা করিডোরের যে কোন একটিতে দাঁড়ালেই এসব বালিঘড়ির বালি ঝড়ার ক্ষীণ, অশেষ শব্দ শোনা যায় । চলবে…..

Related posts