কলা পর্যালোচনা 

শঙ্খচিলঃ ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে “অন্যের ধারনা” আরাফাত হোসাইন

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পারিক একটি অস্পষ্ট ও ছায়াচ্ছ ভাবমূর্তি তৈরির পশ্চাতে ভূমিকা রেখেছে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ। ঐতিহাসিক এই ভূ-বিভাজন উভয় রাষ্ট্রের ভূ-রাজনীতি ও ভূ-কৌশলগত অবস্থান ছাপিয়ে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করেছে প্রাচীরবন্দী এক ‘অন্যের ধারনা’ ( Sense of Others), যা পারস্পারিক আস্থা, আকাঙ্ক্ষা এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সমতা ও ন্যায্যতার মাত্রাকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘ শঙ্খচিল’ সিনেমাতে দুদেশের মধ্যকার ‘অন্যের ধারনা’র নির্মম ভূ-বাস্তবতার দৃশ্যপট চিত্রায়িত হয়েছে। যেখানে ফুটে ওঠে সমসংস্কৃতির পরিচয়ের অন্তরালে আগ্রাসী ভূ-কৌশলগত অবস্থানের নিরিখে সামরিক শক্তি প্রদর্শন কিভাবে দু’পাড়ের মানুষের মধ্যে ‘অন্যের ধারনা’ তৈরি করে সামাজিক বিভাজন আরোপ করেছে।

প্রারম্ভিক কথাঃ

ভূ-রাজনীতি একটি জটিল, গতিশীল ও আন্তঃসম্পর্ক নির্ভর ধারনা, যেখানে আলোচিত হয় ভূমির উপর রাজনৈতিক শক্তির প্রতিফলন। ভূ-রাজনীতি মূলত পররাষ্ট্রনীতি ও রাজনৈতিক প্রপঞ্চসমূহের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। ‘শঙ্খচিল’ সিনেমাতে ভূ-রাজনীতির আলোকে ভূ-সীমানা সংহতকরনে আধিপত্যবাদ, অমানবিক আচরণ ও অসম শক্তি সম্পর্ক সামনে ওঠে এসেছে।

অন্যের ধারনা (Sense of Others) প্রত্যয়টির মাধ্যমে পারস্পারিক দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা নির্দেশ করে। সমাজবিজ্ঞানীরা একে রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিসরের আলোকে সামাজিক আত্মপরিচয়ের সাথে যুক্ত করেছেন। এখানে ‘অন্যের ধারনা’ বলতে রাষ্ট্রীয় সীমারেখা বিপরীতে দাঁড়িয়ে দূরত্ব সৃষ্টি করছে তা অনুসন্ধান করা হয়েছে। তাই ‘অন্যের ধারনা’ মোটাদাগে সমাজ, সংস্কৃতি হতে জনমনস্তাত্ত্বিক বিচ্ছিন্নতার সংজ্ঞায়ন।

শঙ্খচিলঃ ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতঃ
শঙ্খচিল দেশের দক্ষিণপ্রান্তের রক সীমান্তবর্তী জনপদের গল্প। দেশভাগ, দেশত্যাগ ও মানুষের উপর আরোপিত ভূ-রাজনৈতিক ভোগান্তি নিয়ে কাহিনীটি ডালপালা মেলেছে। জটিল রোগে আক্রান্ত গল্পের কিশোরী রুপসার দিন কাটে প্রকৃতির সান্নিধ্যে। তাৎক্ষনিক ও উন্নত চিকিৎসার জন্য মা-বাবা তাকে ভারতে নিয়ে আসে। বাবা বাদল চৌধুরী পরিচয় গোপন রেখে রুপসার চিকিৎসা চালায় কোলকাতায়। এক পর্যায়ে রুপসার মৃত্যুতে প্রকশিত হয় তাদের আত্মপরিচয়। মা-বাবাকে ভারতের কারাগারে (কথিত অনুপ্রবেশের দায়ে) রেখে রুপসার লাশ খুঁজে নেয় বাংলাদেশের মাটি। সিনামাটির মূল উপাদান ছিলো ভূ-রাজনৈতিক পরিচয় ( Identity Politics) , সঙ্কীর্ন সার্বভৌমত্ব থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সিনেমাটি বিশ্বায়নকে সামনে আনার প্রচেষ্টা দেখিয়েছে। সামাজিক পট অস্বীকার করে উপনিবেশ প্রসূত সাম্প্রদায়িকতাও এখানে হাজির। বাদল চৌধুরীর পরিবার ভারতে গিয়ে এক সাম্প্রদায়িক ধাঁধায় অবতীর্ণ হয়। সিনেমার একাংশে দেশভাগ প্রাক্কালে দুই নৌকার ভিন্ন গন্তব্য আমরা দেখি। একটির গন্তব্য হিন্দুস্থান, অন্যটি পাকিস্তানের পথে। তাই বাদল চৌধুরীর জিজ্ঞাসা, ‘ নদী তুমি কার? হিন্দু না মুসলমানের? এখানে সমপ্রকৃতি, প্রয়োজনকে (বেঁচে থাকা) খারিজ করে মূখ্য হয়ে উঠে ‘নির্মিত’ পরিচয় বা সত্ত্বা। বস্তুত, সৃষ্টি হলো ‘অন্যের ধারনা’।

জাতীয়তাবাদের স্রোত থেকে বেরিয়ে ১৯৪৭ এ ক্রমাগতভাবে ক্ষুদ্র এ সংকীর্ণ বিভাজনে নিজেদের মগ্ন করেছে ভারতবর্ষের শাসকগোষ্ঠী। সিনেমাসূত্রে বাংলাদেশ ভারতের সীমান্ত অঞ্চল ৪০৯৫ কি.মি, যার ১০০০ কি.মি. পানিপথে। সিনেমার শুরুতেই বিসংহত সীমারেখার দৃষ্টান্তরুপে এক গ্রামের বর্ণনা পাই। সেই গ্রামে অবস্থিত সাদা পতাকা দণ্ডায়মান বিভাজনের প্রটীক হিসেবে। বি.এস.এফ এক কর্তার জবানে এই অসংলগ্ন সীমান্তের দায় রেডক্লিফের কাঁধে। তিনি একে ‘ Complex land border’ ও ‘ poorest border’ বলে সীমান্তে মানুষ হত্যার দায় এড়ালেন। তার মতে এই দায় ইতিহাস ও অদূরদর্শী এলিট শ্রেণীর। এটি সত্য যে দেশত্যাগপূর্ব দাঙ্গা ও দেশত্যাগ হিন্দু-মুসলমানদের একটি সমপাটাতনে দাঁড়ানোর পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছিল। সিনেমা বাদল চৌধুরী তার পূর্ব পুরুষের পুরোনো চিঠিতে এই সূত্র খুঁজে পান। হুগলিতে দোস্তের কাছে লেখা চিঠিতে আব্দুল গনি বলেন, ‘বাঙালী বলিতে আর কেহ রহিল না, রহিল কেবল হিন্দু আর মুসলমান’। সিনেমাটিতে একটি সীমাহীন সীমান্তের কথা চিন্তা করে হয়েছে। গল্পের রুপসা চরিত্র শঙ্খচিল হয়ে সীমাহীন আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তাই পাখিদের ভারতে উরে যাওয়া নিয়ে তার জিজ্ঞাসা, ‘ওরা পারে আমরা পারি না কেন’? বাদল সাহেব জবাব দেয়, পাখিদের দেশ নেই, আর আক্ষেপের স্বরে বলেন, মানুষ ও যদি কখনো মানচিত্রের গণ্ডি উপেক্ষা করতে পারত! পরিশেষে আমরা দেখি ভূ-রাজনীতির আপাত ও চূরান্ত ভার কিভাবে প্রান্তের জনগোষ্ঠীর উপর প্রভাব বিস্তার করে।

বিশ্লেষণ পর্বঃ
হোর্হে লুইস বোহের্সের ‘প্রাচীর ও পুস্তক’ বইতে বর্ণিত ১ম সম্রাট কিল শি হুয়াং প্রাচীর নির্মান ও বই পুড়ানোর অভিযান চালান। ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রন কল্পে তিনি ভূ-সীমানায় প্রাচীর নির্মানের মাধ্যমে ‘অন্যের ধারনা’ সংহত করেন, ফলে ভূ-সীমানায় প্রাচীর কেবল আলাদা মনস্তাত্ত্বিক নির্মাণ নয়, ইতিহাসের দেনাও বটে। দুদেশের সীমান্তে অস্থিরতা ও ভৌগলিক আধিপত্যকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব অব্যবহতভাবে প্রান্তের বাসিন্দাদের নিকট এক ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে।

ভূ-রাজনীতির এই পরিসরে ভারতের আঞ্চলিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসাবে সীমান্তে ‘সামরিক সমাধান’ এর প্রয়াস দৃশ্যমান। পাশাপাশি ভারতে বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশ সাধারণ ভারতীয়দের বিমাতাসুলভ আচরণের কারন। ‘বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ’ বিষয়টি ভারতের রাজনৈতিক মহলে দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে। এর মূল কারণ নিছক অনুপ্রবেশ ভীতি নয়, বরং ভারতের অভ্যন্তরীন রাজনীতি। এই ইস্যুকে সেখানে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগানো হয়। দ্বিপাক্ষিক পরিমন্ডলেও এর একটি প্রভাব আছে।

মানুষের ইতিহাস অভিবাসনের ইতিহাস। দেশভাগ পূর্ব দুবাংলার সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সত্তা ছিল অবিভাজ্য। পূর্ব বাংলা উৎপাদন ও কাঁচামাল সরবরাহ করতো আর পশ্চিম বাংলা তা দিয়ে বাজারও শিল্প পরিচালনা করতো। ৪৭ এর পর এই একক কাঠামো ভেঙে নয়া কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু, প্রান্তের মানুষের জীবিকা ও জীবনের যোগাযোগ নিঃশেষ হয়ে যায় নি। নতুন রাষ্ট্র কাঠামো এই সম্পর্ককে নিরুপন করতে পারে নি। হাজার বছরের সমাজ-সংস্কৃতিকে নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা অবদমন করে সৃষ্টি করলো ‘অন্যের ধারনা’। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সনাতন ভূ-রাজনৈতিক কৌশল জারি আছে। অথচ, আধুনিক ভূ-রাজনীতি খোলাবাজার ও গণতন্ত্রের সম্প্রসারণে মনোযোগী।

গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘শঙ্খচিল’ সিনেমায় রাষ্ট্রের প্রাচীরবন্দীকরন নীতির সমালোচনা করা হয়েছে। অসীম, অপ্রতিরোধ্য, কাটাটার নির্ভর সার্বভৌমত্বকে জানানো হয়েছে পুনর্বিবেচনার দাবি। কারন, রাষ্ট্রের অতি আত্তীকরণ প্রবনতা ক্রমশ নাকচ করছে মানুষ, সমাজ ও সমাজঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে। রাষ্ট্র সমাজকে আর যোগাযোগ নির্ভর ও মানবিক অবস্থায় নির্ধারণ করতে পারছে না। যেখানে আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র Frankenstein গল্পের বৃহৎ দৈত্যের মতো ব্যক্তিকে গিলে খাচ্ছে। সিনেমায় আমরা একটি বিবাহ ও গ্রাম্য মেলার দৃশ্য দেখি। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক এমন ক্ষেত্রগুলোতে প্রবেশাধিকার রুদ্ধ করেছে কাঁটাতার। অথচ বাংলাভাগ পূর্ব সময়ে প্রবেশাধিকার প্রশ্নটিই ছিলো অবান্তর। জনগণ অবধারিতভাবে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক আদানপ্রদানে লিপ্ত হতো। কিন্তু ৪৭ পরবর্তীকালে আন্তঃজনগণ সম্পর্ক ( People to People বা P To P) ক্রমবর্ধমান হারে হ্রাস পাচ্ছে। আগ্রাসী ভূ-রাজনীতির পরিণতিস্বরূপ বাড়ির পাশের পড়শি আজ ‘অন্য’ বা ‘অপর’।

মানচিত্র নির্ভর সনাতন ভূ-রাজনীতি রাষ্ট্রযন্ত্রকে শক্তিশালী করতে গিয়ে আড়াল করেছে মানুষের গল্প ও ইতিহাস। ‘শঙ্খচিল’ সিনেমাটিতে পরিচালক বাদল চৌধুরীর পরিবার ও রাষ্ট্রীয় সীমারেখাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। সিনেমায় আরো উঠে আসে সীমান্তে মানব ও পণ্য পাচারের দৃশ্য। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বৈষম্য ও দারিদ্র জারি রেখে বহিস্থঃসার্বভৌমত্ব রক্ষা করা কঠিন। মিটেলম্যানের ভাষায়, ‘দারিদ্র যেখানে তীব্রতর অপরাধী গোষ্ঠীগুলো সেখানে সক্রিয় হয়ে উঠে’। সমাজ-অর্থনীতিকে অগ্রাহ্যের ফলস্বরুপ প্রান্তের বাসিন্দাদের শ্রমজগৎ যেমন বিঘ্নিত হচ্ছে তেমনি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে রাষ্ট্রের পুনরুৎপাদন ব্যবস্থা। তাই রাজনৈতিক সম্পর্ককে ব্যপকভাবে অর্থনীতি কেন্দ্রিক করে ফেলা দরকার। মনে রাখা দরকার, সক্ষমতা বিচারে এদেশের ভূ-অর্থনীতিই ভূ-রাজনীতি। পাশাপাশি উভয় রাষ্ট্রকেই মানচিত্র দেখে প্রতিবেশী বিবেচনা করার মানসিকতা থেকে সরে আসতে হবে।

আমরা ‘শঙ্খচিল’ সিনেমার শেষাংশে নির্মম নিয়তিই দেখতে পাই। উপনিবেশ শাসনসৃষ্ট ‘অন্যের ধারনা’ উত্তর উপনিবেশকালেও বর্তমান। কারণ, জনগণের আন্তঃযোগাযোগ ও মিথস্ক্রিয়ার ঘাটতি দুদেশের মানুষের মণোজগতে ‘ভূগোলবন্দী’ ভাবমূর্তি নির্মাণ করেছে।

শেষ কথাঃ
তেলের শিশির ভাঙলো বলে

খুকুর পরে রাগ করো,

তোমরা সেসব বুড়ো খোকা

ভারত ভেঙে ভাগ করো।

৪৭ এর ভারত ভাগ প্রাক্কালে বৃটিশ উপনিবেশ শক্তিবাংলাকেও ভাগ করে। অরক্ষিত ভূ-সীমান্ত নয়, বরং ভূ-কৌশলগত জাতীয় স্বার্থ রক্ষাপূর্বক মানবিক দৃষ্টিসম্পন্ন ভূ-রাজনীতিই এর সমাধান। ‘অন্যের ধারনা’ হ্রাসকরণ ও জনগণের ভূগোলবন্দী ভীতি দূরীকরণে রাষ্ট্রকে আসতে হবে সমাজের কাছাকাছি। মূলত, ‘শঙ্খচিল’ সিনেমাতে মানচিত্রের ঊর্ধে উঠার প্রয়াশ থাকলেও এটি দিনশেষে এক ভৌগলিক বাস্তবতার চিত্রায়ন।

Related posts

Leave a Comment